জীবন ও জীবিকার প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। একজন মানুষের জীবনে প্রশিক্ষণ যে কতো বেশি প্রয়োজন তা আবালবৃদ্ধবনিতা কারো কাছে অজানা নয়। এমন কোনো পেশা নেই যেখানে প্রশিক্ষণ নিতে হয় না। তবে প্রশিক্ষণের ধরন ও পার্থক্য রয়েছে, থাকাটাও স্বাভাবিক। সেই প্রশিক্ষণটা হতে পারে কাউকে অনুসরণ করে অথবা কারো সাহায্য নিয়ে অথবা নিজেই নিজেকে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে। নতুন কিছু শেখা হলো এক বাস্তব প্রশিক্ষণ যার থেকে পরবর্তী বাস্তবতাকে মোকাবিলা করতে সাহায্য পারে। জীবন ও জীবিকার প্রতিটি ধাপে কোনো কাঙ্ক্ষিত অথবা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মোকাবিলা করে এগিয়ে চলাও মনের অজান্তেই শেখা প্রশিক্ষণের ফল। মঞ্চে অভিনয় করার প্রশিক্ষণটা কিন্তু অন্যগুলোর থেকে অনেকটাই ভিন্ন। মঞ্চটা যদি হয় শিখন-শেখানো শিক্ষার মঞ্চ বা জ্ঞান অন্বেষণ করা ক্ষুদে দর্শনার্থীদের মঞ্চ, যেই মঞ্চে অভিনেতা যখন একজন শিক্ষক তবে তো তাকে আরো বেশি দক্ষ কৌশলী হতে হবে অভিনয়ে। এ সবই সম্ভব একমাত্র প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে।
তবে যতোই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করুন না কেনো নিজেকে নিজেই বদলাতে না পারলে বার বার প্রশিক্ষণের কথা বলা তার জন্য ফলপ্রসু হওয়ার কথা নয়। এখানেই আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়। যখন দেখি মাঝে মধ্যেই সরকারি-বেসরকারি অনেকে প্রশিক্ষণ নিয়েও নিজেকে বদলাতে পারা গেলো না তখন খুবই খারাপ লাগে। সেই দায়ভার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিতে যাবে কেনো বরং নিজের প্রতি ক্ষোভ জেগে ওঠার কথা। সেই ক্ষোভে যদি নিজেকে শুধরে নিয়ে আবারো মঞ্চে অভিনয় করার জন্য প্রস্তুত হওয়া যায়, তবেই সার্থকতা।
বাস্তবে যা দেখা যায়, শিক্ষাদানে নিয়োজিত প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং মাদরাসা পর্যায়ে শিক্ষকদের একটা বড় অংশ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন শুধু আর্থিক লাভের জন্য, নিজেকে বদলানোর জন্য নয়। কথাটা অনেকের কাছে রূঢ় মনে হলেও বাস্তবতা তাই বলে। রাষ্ট্র, সরকার শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভাগ সর্বদা শিক্ষকদেরকে পাঠদানের পদ্ধতি, কৌশল, কারিকুলাম বিষয়ক ধারণা, মতামত নীতি-আদর্শ, দেশপ্রেম সর্বোপরি সামাজিক মূল্যবোধ শিক্ষকদের যথোপযুক্ত যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। কিন্তু দেখা যায় শিক্ষকদের একটা অংশ নীতি-নৈতিকতার ধারের কাছে না গিয়ে বরং একান্তই নিজের মতো করে গতানুগতিকভাবেই চলছেন। প্রশিক্ষণে যা কিছুই শেখেন তা প্রশিক্ষণ স্থানেই রেখে আসেন। প্রশিক্ষণে তিনি যা শিখলেন তা শিক্ষাদান নামক মহান কাজে তার প্রয়োগ দেখা যায় না। তার জন্য গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার জন্য অনেকাংশেই দায়ী হতে পারে।
এক্ষেত্রে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের রুটিনমাফিক কাজের বাইরে গিয়ে প্রশিক্ষণ পরবর্তী তদারকিসহ শিক্ষকদের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ মনোভাব শিক্ষকদের উৎসাহ উদ্দীপনা জাগিয়ে পাঠদানের দক্ষতা বাড়াতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ প্রশিক্ষকদের দায়সারাভাবের কারণেই প্রশিক্ষণ পরবর্তী কাজের মূল্যায়নের অভাব পরিলক্ষিত হয়। ভাবখানা অনেকেরই এমন যে শিক্ষকদেরকে তাদের অধীনস্থ মনে করে এবং প্রশিক্ষণের পরে তাদের আর কোনো দায়িত্ব নেই।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের দুর্বল পাঠদানের এই অবস্থার জন্য কর্মকর্তা, প্রশিক্ষকরাও কম দায়ী নন। তবে শিক্ষকদেরকে মনে রাখা উচিত সবকিছুর ঊর্ধ্বে থেকে সবচেয়ে বড় কথা জাতি গড়ার যে মহান ব্রত নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় আসা সেই মহান পেশার প্রতি বুড়ো আংগুল দেখিয়ে চললে কিন্তু তার জন্য এক সময় নিজেকে অনুশোচিত হতে হবে তখন হয়তো নিজেকে শুধরানোর সময়টুকুও থাকবে না। তাই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেকে বদলিয়ে শিক্ষার মঞ্চে সফলভাবে অভিনয় করা নৈতিকভাবে আবশ্যিক যাতে করে ক্ষুদে দর্শকরা শিক্ষক নামের সফল অভিনেতার মনোমুগ্ধকর অভিনয়ে বিমুগ্ধ হয়ে তাদের জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে পারে এবং সেই অভিনেতার অভিনয় দক্ষতা তাদের জীবনে এনে দিতে পারে অনেক বড় সফলতা।এক্ষেত্রে বর্তমান যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক ও বিষয়ভিত্তিক কারিকুলামের উদ্দেশ্য সঠিকভাবে অনুধাবন অনুশীলন ও প্রয়োগে শিক্ষকদের আন্তরিকতা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। একমাত্র একজন ত্যাগী, কর্মনিষ্ঠ, একাগ্রচিত্ত এবং দেশপ্রেমী শিক্ষকই পারেন যুগোপযোগী পাঠদানে সঠিকভাবে মেধা মনন অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে নিজেকে সমর্পিত করে উন্নত জাতি গঠনে অবদান রাখতে। এক্ষেত্রে পাঠদান সফল করতে কারো যদি কোনো ঘাটতি থাকে তবে দক্ষ সহকর্মীদের সহায়তা নেয়া লজ্জার বা হেয় হওয়ার কোনো বিষয় নয় বরং আমাদের ধারণা থাকা আবশ্যক অনেক সময় ছোটদের কাছ থেকেও মাঝে মধ্যে অনেককিছুই শেখা যায়। তাই প্রশিক্ষণকে মনের মধ্যে জায়গা দিয়ে একজন সফল অভিনেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের সামনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা একজন শিক্ষকের জন্য একদিকে যেমন মর্যাদাপূর্ণ ঠিক তেমনি অন্যদিকে দেশ ও জাতি গঠনে তার ভুমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে সেই মহান শিক্ষক অভিনেতার শিক্ষাদানে।
তাই শ্রেণি পাঠদানের অভিনয়ে যাওয়ার আগে বারবার নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে আজকের অভিনয়ে কীভাবে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মনযোগ আকৃষ্ট করতে হবে, কীভাবে তাদের সুপ্ত প্রতিভাগুলো টেনে বের করতে হবে, কীভাবে সকলকে শেখার জগতে বিচরণ করাতে হবে, কীভাবে অভিজ্ঞতাগুলো অর্জন করাতে হবে এবং কীভাবে অভিজ্ঞতাগুলো প্রয়োগ করাতে হবে। আর প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে এভাবেই দিন দিন নিজেকে একটু একটু করে পরিবর্তন করিয়ে একজন সফল অভিনেতার ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করুন একজন সফল শিক্ষক হিসেবে এবং সত্যি সত্যিই দেখা যাবে শিখন শেখানো জগতটা অনেক বেশি সুন্দর, অনেক বেশি আনন্দের। সেই আনন্দের জগতটা যে নিজেই তৈরি করেছেন তা ভেবে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করতে করতে সব সুখগুলোর উঁকিঝুঁকিতে পরিপূর্ণ হবে এই সুন্দর বাংলাদেশ, এই সুন্দর পৃথিবী।
লেখক : শিক্ষক, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার কলেজিয়েট ইন্সটিটিউট, পঞ্চগড়
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।