বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অগ্রগতি সত্ত্বেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, যা দেশের সার্বিক উন্নয়নের পথে অন্তরায়। এই চ্যালেঞ্জগুলো বিভিন্ন স্তরে বিদ্যমান এবং এর সমাধান না হলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো আলোকপাত করা যেতে পারে।
শিক্ষার বিস্তৃতি ঘটলেও গুণগত মান নিশ্চিত করা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পাঠ্যক্রম, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং মূল্যায়ন পদ্ধতিতে গুণগত মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা এবং বাস্তবজ্ঞান বৃদ্ধির চেয়ে পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। তাদের মাঝে পরীক্ষার একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলমান রয়েছে। বিশেষ করে অভিভাবকদের মধ্যে। অভিভাবকেরা সন্তান কতোটুকু শিখছে তার চেয়ে বেশি মনোযোগ সন্তান পরীক্ষায় কেমন করছে সেদিকে। ফলে সন্তানের গুণগত মান উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না।
শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। সমস্যা সমাধান ও নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের দক্ষতা তুলনামূলক কম। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা এবং ক্লাসরুমে কার্যকর পাঠদান নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
শহর ও গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষার মান ও সুযোগ-সুবিধার মধ্যে একটি বড় বৈষম্য রয়েছে। শহরের স্কুলগুলোতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও দক্ষ শিক্ষক পাওয়া গেলেও, গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে এই সুবিধাগুলো অপ্রতুল। অনেকে বিসিএস দিয়ে শিক্ষক নিবন্ধন দিয়ে তাদের চাকরি গ্রামে শুরু করলেও তারা যেকোনো মূল্যে শহরে আসার চেষ্টা করে। ফলে গ্রামের সন্তানেরা ভালো শিক্ষক না পাওয়ার কারণে গুণগত শিক্ষা পান না। এর দ্বারা শহর এবং গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে একটা বিস্তর পার্থক্য তৈরি হয়ে যায়।গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো দুর্বল, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া, শিক্ষক সংকট এবং পাঠ্য উপকরণের অপ্রতুলতাও একটি সমস্যা।
গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বেশি। শিক্ষার মানোন্নয়নে শহর ও গ্রামের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এই বৈষম্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্ম দেয়। সেজন্য গ্রাম অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়ন করা, দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ ও প্রণোদনা দেয়া ও প্রযুক্তির মাধ্যমে দূরশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলেও, সারা দেশে তা সমভাবে বিস্তৃত হয়নি। শহরের বিদ্যালয়গুলোতে প্রযুক্তির ব্যবহার বেশি হলেও, গ্রামের বিদ্যালয়গুলো এখনো প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে। গ্রামের স্কুল কলেজগুলো এখনো প্রযুক্তি নির্মাণ নয়। শহরের ভালো ভালো স্কুল কলেজগুলোতে প্রজেক্টরের মাধ্যমে শিক্ষকেরা ক্লাস নিয়ে থাকেন। ফলে শিক্ষক তার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে শিক্ষার্থীর মান উন্নয়ন করতে সক্ষম হন। অন্যদিকে গ্রামে ইন্টারনেট ব্যবস্থা সে পরিমাণে সচল নয়। ফলে গ্রামের শিক্ষকেরা এবং তাদের প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তিতে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
শিক্ষার্থীরা তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল বিভাজন বৃদ্ধি পায়। আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সীমিত থাকে। সেজন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের ডিজিটাল প্রশিক্ষণ দেয়া ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে প্রযুক্তি সরবরাহ বৃদ্ধি করা দরকার।
বাংলাদেশের অনেক বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। বিশেষ করে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষক সংকট প্রকট। এ ছাড়া, অনেক শিক্ষকই আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতিতে প্রশিক্ষিত নন। অনেকে বিসিএস দিয়ে শিক্ষাক্যাডারে যোগদান করলেও তারা শিক্ষা ক্যাডারের থাকতে চান না। শিক্ষা ক্যাডার থেকে অন্য ক্যাডারে যাওয়ার চেষ্টা করেন। মেধাবীরা শিক্ষক হতে চান না। শিক্ষক মেধাবী না হলে কখনোই শিক্ষা খাত উন্নত করা সম্ভব নয়। এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। শিক্ষকেরা যথেষ্ট অবহেলিত। তাদের বেতন ভাতা সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি উন্নত না হলে এই পেশায় না থাকাটাই স্বাভাবিক। ফলে ক্লাসে কার্যকর পাঠদান সম্ভব হয় না, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত যত্নের অভাব হয় ও শিক্ষার মান কমে যায়। এসব সমস্যা সমাধানে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। নিয়মিত শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং শিক্ষক প্রণোদনা ও সুবিধা বৃদ্ধি করা।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অতিমাত্রায় পরীক্ষাকেন্দ্রিক। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন শুধুমাত্র লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে করা হয়। ফলে তাদের বাস্তব দক্ষতা, সৃজনশীলতা এবং নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশের সুযোগ কমে যায়। যদি আমরা বহির্বিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে তারা গতানুগতিক পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করেন। তারা অনেক বেশি হাতে-কলমে শিক্ষা দেন। একজন শিক্ষার্থীকে মাঠে ময়দানে যোগ্য করে তোলেন।
এর ফলে শিক্ষার্থীরা মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পরীক্ষা ভীতি ও মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়। চাকরির বাজারে বাস্তব দক্ষতার অভাব দেখা যায়। এ সমস্যা সমাধানে দক্ষতা ও কর্মমুখী মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা। নির্ধারিত পরীক্ষার বাইরে কার্যক্রম মূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত করা।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার একটি বড় সমস্যা। দরিদ্রতা, সামাজিক কুসংস্কার এবং অবকাঠামো জনিত কারণে অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ না করেই স্কুল ছেড়ে দেয়। এর অন্যতম কারণ বাংলাদেশের আর্থিক অসচ্ছলতা। মানুষকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করা না গেলে জোর করে স্কুলে বেঁধে রাখা যায় না। তাই বেশিরভাগ গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীরা পড়ার মাঝ পথে ঝড়ে যান। কন্যাশিশুদের স্কুলে যাওয়ার হার বাড়লেও, মাধ্যমিক পর্যায়ে এসে তাদের ঝরে পড়ার হার বেশি। এর ফলে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করতে পারে না। কর্মক্ষেত্রে অদক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ে।
এ সমস্যা সমাধানের জন্য স্কুলে দুপুরের খাবার কর্মসূচি সম্প্রসারণ করতে হবে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি এবং সহায়তা দেয়া দরকার। স্থানীয় সম্প্রদায়কে শিক্ষায় সম্পৃক্ত করাও জরুরি।
উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে গবেষণার সুযোগ ও তহবিল কম। গবেষণাকর্মে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই। অথচ উন্নত রাষ্ট্রে শিক্ষার গবেষণার জন্য একটি বড় বাজেট প্রণয়ন করা হয়। শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে গবেষণা সুযোগ দেয়া হয়। এর পাশাপাশি তাদের উপবৃত্তি এবং আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়। গবেষণা ছাড়া শিক্ষাক্ষেত্র কখনোই উন্নত হতে পারে না। ফলে আন্তর্জাতিক মানের জ্ঞান সৃষ্টি হয় না। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল চিন্তা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা বিকশিত হয় না। সুতরাং গবেষণার জন্য বিশেষ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ তৈরি করাও গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষিত বেকারত্ব বাংলাদেশের অন্যতম বড় সমস্যা। অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেও চাকরি পাচ্ছে না। এর কারণ, শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করতে পারছে না। দরকার আমাদের যুবকদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের যোগ্য করে তোলা। চাকরির অনেক ক্ষেত্র এখনো শূন্য আছে কিন্তু দক্ষ মানুষ পাওয়া যায় না। দেশে দক্ষ মানুষ নেই। অদক্ষ মানুষ বেকার থাকবে এটাই স্বাভাবিক। অনেক ক্ষেত্রেই শিল্প ও কর্মক্ষেত্রের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী তৈরি হচ্ছে না। ফলে শিক্ষিতরা বেকার থেকে যাচ্ছে।
সরকার ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করছে। ইতোমধ্যে ‘শিক্ষা দীক্ষা’, ‘মুক্তপাঠ’ ও ‘ডিজিটাল ক্লাসরুম’ প্রজেক্টের মাধ্যমে শিক্ষায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুলের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। কিছু প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা দিচ্ছে। সঠিক তদারকি ও মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এগুলো আরো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন ইউনেস্কো, বিশ্বব্যাংক, এবং এডুকেশন ফর অল প্রোগ্রামের মাধ্যমে সহযোগিতা করছে। কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা সম্ভব। সরকার ইতিমধ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় জোর দিচ্ছে।
মাদরাসা শিক্ষায় আধুনিক বিষয় অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এটি মূলধারার শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা সম্ভব। এতে মাদরাসা শিক্ষার্থীরাও আধুনিক চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারবে।
এসব সমস্যা সমাধানে করণীয় সুপারিশ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। ১. শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত বাজেট বাড়িয়ে উন্নত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা। ২. শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার নিশ্চিত করা। ৩. পরীক্ষানির্ভরতার পরিবর্তে দক্ষতা ও সৃজনশীলতাকে প্রাধান্য দেয়া। ৪. প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ ও ডিজিটাল সরঞ্জাম সরবরাহ করা। ৫. উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা খাতে প্রণোদনা বাড়ানো এবং গবেষকদের উৎসাহিত করা।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের পথে রয়েছে, তবে সামনে এখনো দীর্ঘ পথ বাকি। চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ বিশ্ব মানের একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। একটি সুশিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে পারলে দেশের সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত হবে।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়