১ জুন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা সর্বজনীন পেনশনের আওতায় ‘প্রত্যয় স্কিমে’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি সংক্রান্ত বৈষম্যমূলক প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্তিকরণ ও স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তনের দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছেন। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ও দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির আহ্বানে এ কর্মবিরতি চলমান। ফলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১ জুলাই থেকে একযোগে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। কিন্তু কেন? রোববার (৭ জুলাই) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত উপম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপম্পাদকীয়তে আরো জানা যায়, গত বছরের ১৭ আগস্ট চারটি আলাদা কর্মসূচি (স্কিম)- প্রগতি, সুরক্ষা, প্রবাস ও সমতা নিয়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়, যা উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রগতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মচারীদের জন্য, সমতা নিম্নআয়ের মানুষের জন্য, প্রবাস শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য আর সুরক্ষা রিকশাচালক, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি ইত্যাদি কর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য যা সারা দেশে সর্বস্তরের মানুষের সাধুবাদ পেয়েছিল। সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রবর্তনের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর শোষণ ও বৈষম্যহীন কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নই বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ গত মার্চের মাঝামাঝি প্রত্যয় নামক নতুন একটি পেনশন স্কিম চালু করার ঘোষণা দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এ স্কিম রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত সংস্থায় ১ জুলাই ২০২৪ থেকে যারা নতুন চাকরিতে যোগ দেবেন তাদের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে প্রযোজ্য হওয়ার কথা। অথচ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকরা পূর্ব থেকেই পেনশন স্কিমের অন্তর্র্ভুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ তাদের জন্য নতুন কোনো স্কিমের প্রয়োজন ছিল না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের তাঁর এক বক্তব্যে উল্লেখ করেন যারা প্রচলিত পেনশন ব্যবস্থার আওতাভুক্ত নন তাদের জন্যই এই জনকল্যাণমূলক পেনশন ব্যবস্থা চালু হবে। এ পেনশন স্কিমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই জোরপূর্বক অন্তর্র্র্ভুক্তি বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের দর্শন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের পরিপন্থি ও সাংঘর্ষিক। আরও বলতে হয় পেনশন পরিচালনা পর্ষদে শিক্ষকদের কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি যা বর্তমান সরকারের অন্তর্র্ভুক্তিমূলক টেকসই উন্নয়নের ধারণারও পরিপন্থি। এ ছাড়া জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত যে প্রত্যয় স্কিম তা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দকে বহুলাংশে বৈষম্যের শিকার হতে বাধ্য করবে।
অধিকন্তু, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দিন বদলের ইশতেহারে শিক্ষা ও মানব-উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে ১০ নম্বর কর্মসূচিতে শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর বেতন কাঠামো ও স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন করার অঙ্গীকার করা হয়। ফলত ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয় যেখানে মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতায় আগ্রহী করতে তারা যাতে যথাযথ মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন সেই লক্ষ্যে শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি এবং সর্বস্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি এবং পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন; কারণ তারা বুঝেছিলেন শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা না গেলে শিক্ষা তথা সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।
কিন্তু পরবর্তীতে আমরা লক্ষ্য করেছি যে এ দেশের শিক্ষকসমাজ বারংবার বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়েছে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে পে-কমিশন শিক্ষকদের পদোন্নতি সর্বোচ্চ তৃতীয় গ্রেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার নীতি গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকসমাজ আন্দোলন করে দ্বিতীয় এবং প্রথম গ্রেডে পদোন্নতির দাবি আদায় করে। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুপার গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
এরকম ধারাবাহিক বৈষম্য এবং বর্তমানে জোরপূর্বক সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্র্ভুক্তি বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের দর্শন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনি অঙ্গীকার, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, অন্তর্র্ভুক্তিমূলক টেকসই উন্নয়ন ও স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রত্যয় স্কিমের বাস্তবায়ন মূলত বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের নীলনকশা এবং এ বিবেচনায় তা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের গত ২ জুলাইয়ের প্রেস রিলিজ অনুযায়ী ৩০ জুন ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যেসব শিক্ষক/কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিতে রয়েছেন তারা আগের ন্যায় সব পেনশন সুবিধা প্রাপ্য হবেন। সুতরাং একই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ধরনের শিক্ষকদের জন্য দুই ধরনের পেনশনব্যবস্থা বৈষম্যের সৃষ্টি করবে এবং কম সুবিধার প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আগ্রহ নষ্ট করবে।
মূলত বিদ্যমান পেনশন স্কিমে বেতন থেকে টাকা কাটা না হলেও প্রত্যয় স্কিমে কাটা হবে, যা বেতনের ১০ শতাংশ। আগে একজন অধ্যাপক অবসরকালে গ্র্যাচুইটি বাবদ এককালীন ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা করে পেলেও বর্তমান নিয়মে তা পাবেন না। আবার আগে পেনশনের ওপর বছর প্রতি ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের ব্যবস্থা থাকলেও নতুন স্কিমে থাকছে না এ সুবিধা। এ ছাড়াও নতুন স্কিমে মাসিক চিকিৎসা ভাতা, দুটি উৎসব ভাতা ও একটি বৈশাখী ভাতার উল্লেখ না থাকাসহ কমছে আরও কয়েকটি সুবিধা। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা মেধাবীদের আকর্ষণ হারাতে পারে এ আশঙ্কায় সারা দেশের শিক্ষকরা লাগাতার কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শিক্ষকসমাজ ধারাবাহিকভাবে মার্চ মাস থেকে শান্তিপূর্ণভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে এলেও একটি বিশেষ মহল সমস্যাটি সমাধানে কোনো আলোচনার উদ্যোগ না নিয়ে উপরন্তু বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক ও অসত্য বক্তব্য দিয়ে শিক্ষক তথা শিক্ষাব্যবস্থাকে হেয় করে আসছে।
১ জুলাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসমাজের আন্দোলন বর্তমানে কর্মরত শিক্ষকদের স্বার্থে নয় বরং বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন রক্ষার আন্দোলন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনি ইশতেহার ও জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের আন্দোলন।
অতীতের ন্যায় দেশ ও জাতির যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে (বায়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তর, একাত্তর, নব্বই, এমনকি ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস ও বিরাজনীতিকরণ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় সুনিশ্চিত করেছিল এবারের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের আন্দোলন সেই ধারাবাহিকতারই প্রকাশ। শিক্ষাব্যবস্থার মর্যাদা রক্ষার্থে এবারের আন্দোলন তাই গোষ্ঠী-স্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতির বৃহত্তর স্বার্থকে অক্ষুণ্ন রাখার আন্দোলন।
লেখক : ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মো. জাহিদ-আল-মামুন প্রভাষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়