বিদেশগামী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অন্যতম পছন্দ যুক্তরাষ্ট্র। তাই দেশটির সাম্প্রতিক ভিসা নীতি সেদেশে অধ্যয়নরত বাংলাদেশিদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। দেশটিতে পড়তে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদনকারীরাও হয়ে উঠেছেন উৎকণ্ঠিত। কেননা, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরাও যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত ভিসা নিষেধাজ্ঞার খাঁড়ায় পড়তে পারেন বলে শঙ্কা জেগেছে।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন সবচেয়ে বেশী। তবে যুক্তরাষ্ট্রগামী কোনো শিক্ষার্থীর বাবা-মায়ের ওপর ভিসা নীতি আরোপিত হলে তার প্রভাব সন্তানদের ওপর পড়ারও শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া ঘোষিত ভিসা নীতিতে উল্লেখিত বিষয়গুলোয় কোনো বিতর্কিত ভূমিকা থাকলে যে কোনো শিক্ষার্থী নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে পারেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্তকারী যে কারো ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ হতে পারে বলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার মন্তব্য করার পর এই শঙ্কা আরো তীব্র হয়েছে।
এছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনের অধীনে, ব্যক্তিগত ভিসার রেকর্ডগুলো গোপনীয় এবং কে প্রভাবিত বা কে হবেন—সে সম্পর্কে আমরা বিশদ বিবরণ দিতে পারি না। কিন্তু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে যদি কেউ ক্ষুণ্ন করেন, তারা এ নীতির আওতাধীন। এ ধরনের ব্যক্তিদের নিকটবর্তী পরিবারের সদস্যরাও ভিসা বিধিনিষেধের আওতাধীন হতে পারেন। কারো বিরুদ্ধে ভিসা বিধিনিষেধ প্রয়োগ করতে হবে কিনা তা নির্ধারণ করতে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্নকারী ব্যক্তিদের সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের ব্যাপক, ভালো এবং সত্য-পরীক্ষিত কেস বাই কেস পর্যালোচনার ওপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর।
তাদের এমন বক্তব্যের পর শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশের ওপর সব ধরনের চাপ প্রয়োগের নীতি নিলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদেরও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনবে। যুক্তরাষ্ট্রগামী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাজনীবিদ, আমলা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সন্তান থাকায় বিষয়টিকে বড় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে।
যদিও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দাবি, উচ্চশিক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভিসা নীতির কোনো প্রভাব পড়বে না।
এ ব্যাপারে সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, ভিসা নীতি শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না। কারণ তাদের দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশী শিক্ষার্থীদের ফি এর ওপর নির্ভরশীল।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এর বক্তব্য, আমাদের শিক্ষার্থীদের শতকরা ৯৯ ভাগই নিজস্ব অর্থায়নে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যান। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে অবদান রাখেন। তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেবে বলে মনে হয় না।
প্রসঙ্গত, সারাবিশ্বের শিক্ষার্থীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র দুই ধরনের ভিসা ইস্যু করে। তাদের মধ্যে এফ-১ ভিসা কেবল শিক্ষার্থীদের জন্য এবং এফ-২ ভিসা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের পরিবারের যেসব সদস্য যুক্তরাষ্ট্রে যান তাদের জন্য।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশটিতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা গত এক দশকে প্রায় তিন গুণ হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য ৬ হাজার ৫৬৬টি ভিসা ইস্যু করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের পরিসংখ্যান বিষয়ক ওপেন ডোরস রিপোর্ট-২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। বিগত ১০ বছরে প্রায় ৭১ হাজার ৫০০ জনের বেশি বাংলাদেশী শিক্ষার্থী শিক্ষার উদ্দেশ্যে দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছেন। তাদের মধ্যে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ৩ হাজার ৮২৮ জন পড়াশুনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। তারপর প্রতি বছরেই ক্রমান্বয়ে এ সংখ্যা বেড়েছে। গত ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ওই সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৫৯৭ জনে।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশ যান স্নাতক শেষ করে। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া শিক্ষার্থীদের ৭০ দশমিক ৩ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট, ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট, ১৩ শতাংশ ওপিটি (অপশনাল প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং) ও ১ শতাংশ নন-ডিগ্রি।
ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ থেকে মোট ৪৯ হাজার ১৫১ জন শিক্ষার্থী বিশ্বের ৫৮টি দেশে পড়তে যান। ওপেন ডোরসের প্রতিবেদন বলছে, একই বছরে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ হাজার ৫৯৭।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।