কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকার মুসার চরের বাসিন্দা আব্দুল হকের মেয়ে মোর্শেদার বয়স ১১ বছর পেরিয়েছে। প্রগাঢ় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এ চরে এবং নিকটবর্তী অন্য কোনো চরে প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় নিজের নাম লেখাটাও শেখা হয়নি তার। একই অবস্থা তার পাঁচ ভাই-বোনেরও। শুধু মোর্শেদা বা তার ভাই-বোনেরা নয়, মুসার চরের শতাধিক পরিবারের সন্তানরাও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পা রাখতে পারেনি। একই অবস্থায় শিক্ষাবঞ্চিত থেকে গেছে ব্রহ্মপুত্র পাড়ের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের পূর্ব মশালের চর ও সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ কালির আলগা চরসহ ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার আরো অসংখ্য দুর্গম চরের শিশুরাও।
মুসার চরের মোর্শেদা জানায়, ‘আমি মায়ের সাথে গৃহের কাজ করি। আমার লেখাপড়া করার ইচ্ছা ছিল কিন্তু এখানে কোনো স্কুল নাই। এজন্য স্কুলে যেতে পারছি না।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, বিদ্যালয় না থাকা চরের শিশুরা কেউ বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করছে আবার কেউ নদীতে মাছ ধরা বা জমিতে কৃষিকাজ করছে। মেয়েরা পরিবারের কাজ করছে মায়েদের সঙ্গে। আর অবসর সময়ে খেলাধুলা করেই দিন পার করছে শিশুরা।
সরকারি হিসাবে কুড়িগ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার, ফুলকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর অববাহিকায় রয়েছে সাড়ে চার শতাধিক চর। আর জেলার ১ হাজার ২৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে চরাঞ্চলে রয়েছে ১৬৯টি বিদ্যালয়। অর্থাৎ সাড়ে চার শতাধিক চরাঞ্চলে রয়েছে মাত্র ১৬৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি শিক্ষাবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার দুর্গম চরাঞ্চলগুলোয়।
স্থানীয়রা জানায়, কিছু চরের পার্শ্ববর্তী চরগুলোতেও কোনো বিদ্যালয় নেই। এসব চরের শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি। অশিক্ষিত অবস্থায় বেড়ে ওঠার পর কম বয়সে হচ্ছে বিয়ে। আবার তাদের সন্তানরাও বেড়ে উঠছে একই ভাবে। অন্যদিকে কিছু চরের পার্শ্ববর্তী চরে বিদ্যালয় থাকলেও ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে যেতে হয় সে বিদ্যালয়ে। কিন্তু ছোট মাছ ধরার নৌকায় ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন নিয়ম মাফিক বিদ্যালয়ে যেতে আগ্রহী নয় শিশুরা। আর ঝুঁকি নিতে চান না অভিভাবকরাও।
আট-দশ বছর আগে জেলার সব চরাঞ্চলে বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে শিশুদের লেখাপড়া করানো হলেও বর্তমানে এনজিওগুলোর দুরবস্থায় সে সুবিধাটুকু নেই।
এ কারণেই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দুর্গম চরাঞ্চলের অসংখ্য কোমলমতি শিশু। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা শেখানোর ইচ্ছা থাকলেও জীবনযুদ্ধে অসহায় হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরাও।
তবে এসব চরের এক-দেড়শ পরিবারের মধ্যে মাত্র চার-পাঁচটি সচ্ছল পরিবার তাদের সন্তানদের অন্যত্র রেখে লেখাপড়া শেখাতে পারছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বছর জেলায় নদীভাঙন ও বন্যার কারণে ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে চার-পাঁচ হাজার পরিবার। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার অববাহিকার বিপুলসংখ্যক পরিবার ভাঙনের কবলে পড়ে। ভুক্তভোগী এসব পরিবার ভিটামাটি হারানোর পর আশ্রয় নেয় নতুন জেগে ওঠা চরে। সেখানে ৮-১০ বছর বাস করার পর আবারো ভাঙনের কবলে পড়ে ভিটামাটি হারায়। আবারো অবস্থান হয় পাশের নতুন চরে। এভাবে যাযাবরের মতো জীবনযাপন করে হাজার হাজার পরিবার। নদ-নদীর ভাঙা-গড়ার খেলায় নিঃস্ব এসব পরিবার কৃষিকাজ ও মাছ ধরার কাজ করে জীবন নির্বাহ করে থাকে। এ অবস্থায় চরে কোনো বিদ্যালয় না থাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার কথা চিন্তাও করতে পারেন না তারা।
ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার মুসার চরের বাসিন্দা জয়নুদ্দি বলেন, ‘আমরা এখানে অসহায়ের মতো পড়ে আছি। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে পারছি না। পাচ্ছি না কোনো চিকিৎসাসেবাও। আমরা চাই মুসার চরে সরকারি হোক বা বেসরকারি হোক একটি বিদ্যালয় দেয়া হোক। তাহলে আমাদের ছেলেমেয়েরা অন্তত নামটা লেখা শিখতে পারবে।’
একই চরের মতিয়ার রহমান বলেন, ‘নদীভাঙনের শিকার হয়ে ১০ বছর হলো মুসার চরে বসবাস করছি। এখানে একশর বেশি পরিবারের দুই শতাধিক সন্তান রয়েছে। সবাই শিক্ষাবঞ্চিত। এমনকি পার্শ্ববর্তী পূর্ব মশালের চর ও দক্ষিণ কালির আলগার চরেও বিদ্যালয় নেই। এ কারণে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানো সম্ভব হচ্ছে না।’
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ কালির আলগা চরের বাসিন্দা ও ইউপি সদস্য আসাদ আলী বলেন, ‘চরে বিদ্যালয় নেই। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনকে অনেকবার বলেছি কিন্তু কোনো উদ্যোগ নেই।’
কুড়িগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম জানান, কুড়িগ্রাম জেলা একটি বন্যা ও নদীভাঙন কবলিত জেলা। প্রতি বছর বন্যা ও নদীভাঙনে চরাঞ্চলের বেশকিছু বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চরাঞ্চলের শিশুরা যাতে লেখাপড়া করতে পারে এজন্য প্রতিটি উল্লেখযোগ্য চরে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের যে উদ্যোগ তাতে বিদ্যালয়বিহীন কোনো গ্রাম থাকবে না। এটি কিন্তু নিশ্চিত করা হয়েছে যে বিদ্যালয়বিহীন কোনো গ্রাম নেই। যে ভৌগোলিক অবস্থা প্রতি বছর পরিবর্তন হয় সেক্ষেত্রে যে চরগুলোয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বল্পতা রয়েছে তা নির্ধারণ করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।