শিক্ষায় এসব কি চলছে? - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষায় এসব কি চলছে?

মাছুম বিল্লাহ |

আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে শেকলের মতো একটির পর একটি ঘটনা ঘটেই চলছে। এর যেনো অন্ত নেই। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কি চলছে সেটি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবারই দৃষ্টি কাড়ে, তাদেরকে ভাবায়, দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয় এবং কাঁদায় কিন্তু কোনো সমাধান নেই। আছে শুধু কথার পিঠে কথা, যুক্তির বিপরীতে যুক্তি। সুবিধা হয়েছে শিক্ষা নিয়ে যেহেতু অনেকেরই সে রকম চিন্তার কিছু নেই, শুধুমাত্র নিজে বা নিজের কেউ যখন আক্রান্ত হয় তখন একটু অনুভূতি প্রকাশিত হয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কি ঘটে চলেছে কেউ যেনো মনেই করছে না যে, এতে শিক্ষার ও দেশের কোনো ক্ষতি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েই যেহেতু আইওয়াশ ছাড়া কিছু হচ্ছে না তাই প্রাথমিকে হতে যাবে কেনো?

গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এবং এবছর ২৮ ফেব্রুয়ারি ফল প্রকাশ হয়। ফল প্রকাশের চার ঘণ্টা পর সেটি স্থগিত করে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে ই-মেইল পাঠানো হয়। পিরোজপুরের এক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় উপস্থিতই হয়নি অথচ সে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। আরও একজনের কথা এসেছে যে, পরীক্ষা না দিয়েই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। এ কেমন খেলা!
 
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন জানিয়েছেন, কোডিংয়ের সমস্যা হওয়ার কারণে প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষার ফল স্থগিত করা হয়েছে এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক পরিচালক জানিয়েছেন, ফলে সমস্যা হওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সবই দ্রুত করা হয়, ফলে ভুলের আরো সম্ভাবনা থেকে যায়। বৃত্তি পরীক্ষার ফলে পরিবর্তন এসেছে। কর্মকর্তার বলতে চাচ্ছেন এটি খুব ছোট সমস্যা। এটি কোনোভাবেই ছোট সমস্যা নয়। তারা মনে করেন, ছোট শিশুদের বিষয় তাই এটি ছোট সমস্যা। একটি শিশু যখন জেনে গেছে যে, সে বৃত্তি পেয়েছে। পরবর্তী সময়ে আবার যখন জানবে সে পায়নি তখন তার মানসিক অবস্থা কি হবে? এটি তো খেলা নয় যে, চাল দিয়েছি ভুল হয়েছে। ধুক্কা দিয়ে আবার নতুন চাল দিচ্ছি।

পরীক্ষার ফল পরিবর্তনে অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবাই একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর যা কেউ ভেবে দেখেন না, বরং বিষয়টিকে হালকা করে বলে ফেলেন, ‘সামান্য একটু ভুল হয়েছে’। এটি কি সামান্য ভুল?

দেশের শিক্ষাবিদরা বৃত্তি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন, কিন্তু পরীক্ষা ঠিকই হয়েছে, এবং তাড়াহুড়া করে হয়েছে। একবার একটি তারিখ দিয়ে পরবর্তীতে দ্রুত পরিবর্তন করে পরীক্ষা নেয়া হলো। ফল প্রকাশ করা হলো আবার তা প্রত্যহারও করা হলো, যেনো বিষয়টি তেমন কিছুই না, নিছক বাচ্চাদের কুতকুত খেলা। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় মোট ৮২ হাজার ৩৮৩ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে, তাদের মধ্যে মেধাবৃত্তি পেয়েছে ৩৩ হাজার এবং সাধারণ কোটায় ৪৯ হাজার ৩৮৩ জন। এতে একেকটি বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়েছিলো। বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতিটিতে ২৫ নম্বর করে মোট ১০০নম্বরের ভিত্তিতে এই পরীক্ষা হয়। করোনা ও গত জানুয়ারি থেকে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়টি মাথায় রেখে গত তিন বছর পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেয়া হয়নি। আগামী দিনগুলোতেও এই পরীক্ষা হবে না বলে ঘোষণা এসেছে। এরই মধ্যে হঠাৎ করে জানা গেলো প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। পরে অবশ্য ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে এ পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিলো। 

পঞ্চম শ্রেণি পেরিয়ে মাধ্যমিকে পা রাখা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কারা কারা সরকারি বৃত্তি পাবে তা নির্ধারণে এক সময় আলাদাভাবে এই পরীক্ষা নেয়া হতো, যা বৃত্তি পরীক্ষা নামে পরিচিত ছিল। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর আলাদা বৃত্তি পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর ফলের ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেয়া শুরু হয়। কিন্তু যারা বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারল না তারা কি সেই আগের মতোই মনে করবে যে, তারা পিছিয়ে পড়া, তাদের দিয়ে কিছু হবে না?

প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের সব ধরনের পরীক্ষা বন্ধ করে শ্রেণি মূল্যায়নের ভিত্তিতে ফল নির্ধারণের চিন্তা করার জন্য বিভিন্ন শিক্ষাবিদ মতামত ব্যক্ত করে আসছেন, তারই বিপরীতে দেখা যায় হঠাৎ করে বৃত্তি পরীক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত যেটি অবাক হওয়ার মতোই বিষয়। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে যে শিক্ষাথী তৃতীয় শ্রেণিতে ছিলো, অটোপাস করে করে সে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে, তাকে যখন পরীক্ষা দিতে বলা হয়েছে তার মানসিক অবস্থা নিশ্চয়ই খুব একটা ভালো ছিলো না। তাছাড়া একটি বিষয়ে ২৫ নম্বরের পরীক্ষা নিয়ে তাদেরকে মেধাবী বলে তাদের গায়ে আলাদা তকমা লাগানোর কোনো প্রয়োজন ছিলো কী? কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি বোঝা না চাপিয়ে গত দুই বছরের শিক্ষা ঘাটতি কীভাবে ধীরে ধীরে দূর করা যায় সে নিয়ে চিন্তা করাই এখন মূল বিষয় হওয়া উচিত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যে উপবৃত্তি দেয়া হয়, সেই পরিমাণ বাড়ালে অনেক বেশি শিক্ষার্থী উপকৃত হতো, শিক্ষায় বিভক্তি কমে কিছুটা সমবন্টন হতো। শিক্ষার এতোসব কেলেঙ্কারি, ঘটনা ও দুর্ঘটনা আমরা জানি তো একমাত্র সংবাদপত্রে। এছাড়া তো আমাদের জানার কোনো উপায়ও ছিলনা। পত্রিকায় দেখলাম কোডিং সংক্রান্ত ভুলের কারণে নাকি এক উপজেলার সঙ্গে আরেক উপজেলার বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী বাছাই বিঘ্নিত হয়েছে বলে সিস্টেম এনালিস্ট জানিয়েছেন, তিনি বলছেন , অল্প কিছু ভুল হয়েছে। এখন সংশোধনের কাজ চলছে। অথচ ঘটা করে সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল জানানে হলো, আবার ঘটা না করে বাতিল করা হলো। আবার বলা হলো তেমন কিছু হয়নি, সামান্য একটু কোডিং সমস্যা হয়েছে। নতুন কারিকুলামের ওপর ভিত্তি করে যে বইগুলো ছাপাহলো সেখানেও একই কথা বলা হচ্ছিলো। বর্তমানে কয়েকটি বই তুলেই নেয়া হলো। শিক্ষার্থীদের কি হবে, শিক্ষকরা কি করবেন ওইসব বিষয়ে, বিদ্যালয়ের কি হবে, কবে বই পাওয়া যাবে তার কোন সদুত্তর কারোর কাছেই নেই। সেই সমস্যার বেড়াজালে আবার প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল! কি চলছে আসলে শিক্ষাক্ষেত্রে?

সর্বশেষ প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা হয় ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে। ওই ফলাফলের ভিত্তিতে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে বৃত্তির জন্য নির্বাচত ৮০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর তালিকা প্রকাশ করা হয়। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিপ্রাপ্তরা মাসে ৩০০ টাকা এবং সাধারণ বৃত্তিপ্রাপ্তরা মাসে ২২৫ টাকা করে পায়। প্রাথমিক সমাপনীর বৃত্তিপ্রাপ্তরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এই বৃত্তি পায়। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা শিক্ষার্থীর মনোজগত তৈরিতে সবচাইতে বেশি ভূমিকা রাখে। এজন্য শিশুদের চাপমুক্ত পরিবেশে শিক্ষাদানকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। মানসিক বিকাশের পর্যায়ক্রমিক ধারায় প্রতিযোগিতামূলক বা মেধাভিত্তিক মূল্যায়নের বিভিন্ন অনুষঙ্গের সঙ্গে সে পরিচিত হবে। আমাদের দেশে যেভাবে শিশু শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বসিয়ে দেয়া হয় তা ঠিক শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে কতটা কার্যকরী তার কোনো প্রকৃত গবেষণা নেই। মেধার বিকাশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সাম্যবস্থার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বিত্তবান পরিবারের সন্তান যে পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করে দরিদ্র পরিবারের সন্তানের জন্য তা চিন্তার বাইরে। এই উভয় শ্রেণির মেধার বিকাশ সমানভাবে হতে পারে না। এই জায়গায় আগে কাজ শুরু করা উচিত। কারণ মেধা আবিষ্কারের সঠিক পদ্ধতি তো এখনও আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি। আমরা শুধু দেখছি একজন শিক্ষার্থী অংকে কতো নম্বর পেলো, ইংরেজিতে কত পেলো সেটি দেখে আমরা তার মেধা যাচাই করছে। অথচ সে আলাদা কোচিং করে, কিছু বিষয় মুখস্থ করে, বার বার শিক্ষকের কাছে অর্থের বিনিময়ে প্রাকটিস করে পরীক্ষার খাতায় লিখে এসেছে, ভাল নম্বর পেয়েছে, তাকে আমরা মেধাবী শিক্ষার্থী বলছি। আর বাকি যারা অর্থের অভাবে, পরিবেশের অভাবে এগুলো দেখাতে পারেনি তারা কি মেধাহীন? এ জায়গায় অনেক কাজ করার আছে। শুধুমাত্র কম্পিটেন্সি বেজড কারিকুলাম চালু করে বলা যাবে না যে সব সমস্যার সমাধান এখানেই রয়েছে। গোটা শিক্ষা প্রশাসনেই চলছে সমস্যা, এর প্রকৃত সমাধান প্রয়োজন। এ রকম  লেজেগোবরে অবস্থায় অবসান হওয়া প্রয়োজন জাতির বৃহত্তর স্বার্থে। 

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

 

 

শিক্ষার্থীদের রাজাকার শ্লোগান লজ্জার: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের রাজাকার শ্লোগান লজ্জার: প্রধানমন্ত্রী কৃষি গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha কৃষি গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত উপহার দিলেই এমপিওভুক্তি! - dainik shiksha উপহার দিলেই এমপিওভুক্তি! কোচিং বাণিজ্যে জড়িত পিএসসির আরো ৪ কর্মকর্তা-কর্মচারী - dainik shiksha কোচিং বাণিজ্যে জড়িত পিএসসির আরো ৪ কর্মকর্তা-কর্মচারী ঢাবির জরুরি বৈঠকে প্রভোস্ট কমিটির পাঁচ সিদ্ধান্ত - dainik shiksha ঢাবির জরুরি বৈঠকে প্রভোস্ট কমিটির পাঁচ সিদ্ধান্ত কোটার পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলনকারীদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি আজ - dainik shiksha কোটার পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলনকারীদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি আজ শিক্ষামন্ত্রী দেশে ফিরছেন আজ - dainik shiksha শিক্ষামন্ত্রী দেশে ফিরছেন আজ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032751560211182