শিক্ষায় সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলির প্রয়োজনীয়তা - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষায় সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলির প্রয়োজনীয়তা

অমিদুর রহমান |

যেসব কার্যাবলি শিক্ষার্থীর মানসিক শক্তি বিকাশের সহায়ক এবং যেগুলো শিক্ষার্থীর সু-সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায়, পাঠক্রমের সহযোগী সেইসব বিষয় বা কার্যাবলিকে বলা হয় সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলি। পূর্বে এ সব কার্যাবলিকে শ্রেণি বহির্ভূত কার্যাবলি বলা হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো স্বেচ্ছাসেবা ভিত্তিক (বাধ্যতামূলক নয়), সামাজিক, জনহিতকর এবং সমবয়সী শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত। কখনো কখনো প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এসব কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে থাকেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা মূল সিলেবাস কিংবা পুঁথিগত বিষয়ের বাইরে নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতার জায়গাগুলোয় উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে যে কাজগুলো করে থাকেন, সেগুলোই এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরণের সংগঠন বা ক্লাব রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত। একজন শিক্ষার্থী যে কোনো সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম- খেলাধুলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, সাঁতার প্রতিযোগিতা, আন্তঃস্কুল ফুটবল, জাতীয় দিবস পালন, স্কাউট, গার্লস গাইড, প্রদর্শনী, নাট্যানুষ্ঠান, বিচিত্রানুষ্ঠান, বাগান তৈরি, বার্ষিক ম্যাগাজিন, শিক্ষা সফর, উৎসব আয়োজন, ক্রীড়ানুষ্ঠান, গান-বাজনা, সামাজিক সংগঠন, গল্প প্রতিযোগিতা, প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা, দেয়ালিকা প্রকাশ, ভাস্কর্য তৈরি, অ্যালবাম তৈরি, ফটোগ্রাফি, ছবি আঁকা, কুইজ প্রতিযোগিতা, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, ম্যাথ বা ফিজিক্স অলিম্পিয়াড, ক্যারিয়ার ক্লাব, স্বেচ্ছাসেবকের কাজ, বইপড়া ক্লাব, বিজ্ঞানচর্চা ক্লাব, রক্তদান কর্মসূচি, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ইত্যাদি।

সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম৷ বিভিন্ন প্রকার সহ-শিক্ষাক্রমিক কাজ শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর যথাযথ মানসিক বিকাশ শিক্ষাগ্রহণকেও ত্বরান্বিত করে। সহশিক্ষাক্রমিক কার্যাবলি শিক্ষার উদ্দেশ্য পূরণের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর জীবন বিকাশে বিশেষভাবে সাহায্য করে৷ যেমন- খেলাধুলা ও শরীর চর্চার বিষয়টি শিশুর দৈহিক বিকাশে বা শারীরিক বর্ধনে সহায়ক ভূমিকা রাখে৷ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অনুশীলন শিশুমনের সুকুমার বৃত্তির উন্মেষ ঘটায় এবং শিশুর নান্দনিকতার বিকাশ সাধন করে৷ সাহিত্য বিষয়ক কর্মকাণ্ডের অনুশীলন শিশুর লেখালেখির হাত মজবুত করে সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ সাধন করে৷ শিশুর সামাজিকতা ও নৈতিকতার বিকাশ সাধনে ভূমিকা রাখতে প্রয়োজন সামাজিক কর্মকাণ্ড বিষয়ক কার্যাবলি৷ যা বিদ্যালয় এবং সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি দায়িত্ব সচেতনতা বোধ জাগায় ও শিশুর মানবিক গুণাবলির উন্মেষ ঘটায়৷ এই ধরণের কার্যক্রমের মধ্যে শিশুরা অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ হওয়ার সুযোগ পায় এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলাবোধ গড়ে ওঠার সুযোগ ঘটে।

শিক্ষামূলক নির্দেশনায় সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলির বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলির মধ্য দিয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পছন্দ, আগ্রহ, দক্ষতা প্রভৃতি দিক নির্দিষ্ট করতে পারেন এবং সেই অনুযায়ী শিক্ষার্থীর উপযোগী শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ বৃত্তির পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে। সহশিক্ষা কার্যক্রমে জড়িত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝরে

পড়ার হার কম, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সম্ভাবনাও বেশ কম। তাছাড়া বিদ্যালয়ের নিয়মিত কাজে সাফল্য ও অর্জনের হারও এদের ভেতর বেশি। উল্লেখ্য এর সব থেকে ভালো সুফল হলো পারস্পরিক যোগাযোগ এবং সম্পর্কের ক্ষেত্র আরো দক্ষ করে তোলা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসামাজিক আচরণের প্রবণতা কমানো।
বিদ্যালয়ের সহশিক্ষা সংগঠনে এবং তার কার্যক্রমে জড়িত থাকা বিকাশমান প্রজন্মের জন্য বেশ উপকারী। এভাবে পাঠ্যক্রমের বাইরের কার্যকলাপে জড়িত থাকা শিক্ষার্থীদের বন্ধুত্ব তৈরির সুযোগ বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিবারের কর্মজীবী সদস্যদের ব্যস্ত থাকাকালীন তাদের সন্তানদের একটি নিরাপদ পরিবেশ সরবরাহ করতে পারে। এটি পিতামাতাকে সমস্ত কাজের পর্যাপ্ত সময় পাওয়ার সুযোগ দেয় এবং শিশুকে শিক্ষামূলক বা ক্রীড়া কার্যক্রমে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়। তদুপরি, সহশিক্ষা কার্যক্রম আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বশিক্ষিত হবার সুযোগ বাড়ায়, তা বিদ্যালয় কিংবা বিদ্যালয়ের বাইরে যেখানেই অনুষ্ঠিত হোক না কেন। তেমনি স্কুলভিত্তিক সহশিক্ষা কার্যক্রম জড়িত কিশোরীরা তুলনামূলকভাবে বেশি আত্মসম্মানের অধিকারী হয়। এতে প্রমাণ হয় যে ক্রীড়া, ক্লাব কিংবা বিদ্যালয়ভিত্তিক অনুষ্ঠান- যে কোনো সহশিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকাই অংশগ্রহণকারীদের ওপর ইতিবাচক প্রভাব রাখে।

এখনকার শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় যে পরিমাণ অংশগ্রহণ করেন বা মগ্ন থাকেন, সেই তুলনায় এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতে দেখা যায় না। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন, নেতৃত্ববোধ, মানবিকবোধ, মানসিক ও সামাজিক বিকাশ, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ইতিবাচকতায় দক্ষ করে তুলতে সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের পছন্দের বিষয়ে অতিরিক্ত যোগ্যতা অর্জন শিক্ষার্থীদের জীবনে বয়ে আনতে পারে সফলতা। এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি একদিকে মেধাকে শানিত করে, অন্যদিকে অর্জিত জ্ঞানকে প্রয়োগ করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাঠ্য বইপত্রের মাঝে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলে একজন শিক্ষার্থীর নেতৃত্ববোধ, মানবিকবোধ, সমাজ-রাষ্ট্র-নিজের বাস্তব জীবন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার সম্ভবনা অনেক বেশি। একজন শিক্ষার্থীর এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি থেকে তার নানা দক্ষতা সম্পর্কে জানা যায়। তাই একাডেমিক রেজাল্টের পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিও সম গুরুত্বপূর্ণ। কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশ, চাকরির প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে রাখা, অভিজ্ঞতা লাভ, সামাজিকীকরণ, দলগতভাবে কাজের শিক্ষা অর্জন, সামাজিক সুযোগগুলো উন্মুক্ত হওয়া, আত্মসম্মান বৃদ্ধি, একাডেমিক পারফরমেন্স উন্নত করা, সময়ের সদ্ব্যবহার, নিজের আগ্রহ প্রকাশ করার সুযোগ অর্জন, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি, বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি সুযোগ ও সুবিধা বা উপকারিতা অর্জিত হয় সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলি থেকে। শিক্ষার্থীরা প্রায়শই বিদ্যালয়ের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ শ্রেণি শিক্ষায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু বৈচিত্র্যময় সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলি সেই একঘেয়েমি কাটিয়ে তাদের মধ্যে বিদ্যালয়ের প্রতি প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি করে। শিক্ষার্থীরা সবার সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে ও অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শেখে। এই গুণগুলো তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশে সাহায্য করে।

শিক্ষার্থীরা নিয়মিত সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিলে তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বাঞ্ছিত মূল্যবোধ গড়ে ওঠে, যা তাদের চারিত্রিক বিকাশের পক্ষে সহায়ক এবং সুস্থ অনুভূতির বিকাশ ঘটায়। সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলি শিক্ষার্থীর মধ্যে সেবামূলক মনোভাব গড়ে তোলে। বিভিন্ন প্রকার সাংগঠনিক কাজে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে সেবামূলক মনোভাব অর্জন করে। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রকার সৃজনশীল গুণের বিকাশেও বিশেষভাবে সহায়ক হয়। এই কার্যাবলী শিক্ষার্থীদের নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক বিকাশেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের ফলে শিক্ষার্থী সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়, যা যে-কোনো মানুষের কাছেই অতি মূল্যবান সম্পদ। সুস্থ দেহেই থাকে সুস্থ মন। দৈহিক বিকাশ যথাযথ হলে তার প্রভাব মনের ওপর পড়ে। মনও পরিণত হয়। শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসে শিক্ষালাভের জন্য। বিদ্যালয়ে বিভিন্ন সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলির মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে সমাজ জীবনের উপযোগী করে তোলা হয়। এই ধরণের কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মধ্যে সামাজিক বিকাশ ঘটে। বিদ্যালয় দ্বারা সংগঠিত বিভিন্ন সহ-শিক্ষাক্রমিক কাজে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে সহপাঠীদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া গড়ে ওঠে, যা শিক্ষার্থীর সমাজ জীবনের পক্ষে অপরিহার্য।

অতএব শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থী সবার মধ্যে সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলির উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে আগামী দিনে সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলির ফলে শিক্ষার্থী এবং সমাজ বিশেষভাবে উপকৃত হবে। সুস্থ মানসিকতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে। ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য বাস্তবায়িত হওয়ার সুযোগ পাবে।

লেখক: থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, গুলশান, ঢাকা। 

‘বারাসাত ব্যারিকেড’ ঘোষণা তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ‘বারাসাত ব্যারিকেড’ ঘোষণা তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীদের রাতারাতি সরকারি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা সম্ভব না - dainik shiksha রাতারাতি সরকারি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা সম্ভব না মনোনীত হয়েও বৃত্তি থেকে বঞ্চিত রাবির ৯ শতাধিক শিক্ষার্থী - dainik shiksha মনোনীত হয়েও বৃত্তি থেকে বঞ্চিত রাবির ৯ শতাধিক শিক্ষার্থী পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা আবু সাঈদ হত্যা মামলায় গ্রেফতার বেরোবির সাবেক প্রক্টর - dainik shiksha আবু সাঈদ হত্যা মামলায় গ্রেফতার বেরোবির সাবেক প্রক্টর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে মাদরাসা-ই-আলিয়ার ভবনে অস্থায়ী আদালত বন্ধের দাবি - dainik shiksha মাদরাসা-ই-আলিয়ার ভবনে অস্থায়ী আদালত বন্ধের দাবি কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি নিয়ে নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি নিয়ে নতুন নির্দেশনা বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল - dainik shiksha বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037031173706055