দেশের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের প্রায় ২৪ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তদারকি করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। এ অধিদপ্তরে বড় পদগুলোতে থাকেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজ শিক্ষকরা। তবে, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের অভিযোগ, পদায়ন, পদোন্নতি, টাইমস্কেল, বদলিসহ নানা বিষয়ে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর তথা শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে চাচ্ছেন না তারা। তাই, জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসারে স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন তারা।
আরও পড়ুন : শিক্ষা ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে বিভাজন চায় না শিক্ষা ক্যাডার
বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষকরা এ দাবি জানান।
তাদের মতে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অবকাঠামোতেই মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বা মাসি প্রতিষ্ঠা সম্ভব, এর জন্য সরকারের বাড়তি খরচ হবে না। আর আলাদা অধিদপ্তর গঠনের ফলে শিক্ষকদের সঙ্গে সঙ্গে মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে।
যদিও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভক্তি চান না সরকারি কলেজগুলো ও শিক্ষার বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা। তাদের মতে, অধিদপ্তর বিভক্ত হলে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের হাতে ক্ষমতা চলে যাবে, যার ফলে শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর প্রশাসন ক্যাডার সদস্য জেলা প্রশাসকরা স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছেন চলমান ডিসি সম্মেলনে। যদিও শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিও মনে করছেন, অধিদপ্তরের বিভাজন হলে সমন্বয়হীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এমন পরিস্থিতিতে মাধ্যমিকের আলাদা অধিদপ্তর ইস্যু গত কয়েকদিন শিক্ষা প্রশাসনের ‘হট টপিকে’ পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন : মাধ্যমিক শিক্ষার আলাদা অধিদপ্তরে সমন্বয়হীনতার শঙ্কা মন্ত্রীর
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীতে শিক্ষা প্রশাসন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের মুখে মুখে ছিলো মাধ্যমিকের আলাদা অধিদপ্তরের ইস্যু। শিক্ষা প্রশাসনের উচ্চপদস্থ পদে কর্মরত একজন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলে তিনি দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ডিসিরা তথা প্রশাসন ক্যাডার আলাদা অধিদপ্তর চাচ্ছেন, কারণ তারা শিক্ষায় ক্ষমতা চান। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রশাসন ক্যাডারের হাতে চলে গেছে, ওই অধিদপ্তরে শিক্ষকদের ঢোকা বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষাবান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য শিক্ষকদের তদারকিতে শিক্ষকদেরই থাকা উচিত।
এদিকে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে আলাদা অধিদপ্তর গঠনের জোর দাবি জানান সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষকরা। 'স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বাস্তবায়ন কমিটি' নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে আয়েজিত সংবাদ সম্মেলনে খুলনা অঞ্চলের সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষকরা নিজেদের ১২ দফা দাবি তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসারে স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার দাবিসহ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের ৫০ শতাংশ পদে সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের পদায়ন ও প্রস্তাবিত মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক ও আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালকের পদসহ পরিদর্শন শাখার অন্যান্য সব পদে সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের পদায়নের দাবি জানানো হয়। সরকারি মাধ্যমিক স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের চেয়ারম্যান ও সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা সমিতির খুলনা অঞ্চল কমিটির সভাপতি মমতাজ খাতুনের নেতৃত্ব সংবাদ সম্মেলনে লিখিত পাঠ করেন আয়োজক সংগঠনের মুখপাত্র ওমর ফারুক।
তারা বলেন, ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় শিক্ষানীতিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর ভেঙে স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর নামে দুটি আলাদা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার কথা বলা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে দিন দিন মাধ্যমিক শিক্ষা অবহেলিত হচ্ছে। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি, এন্ট্রিপদ নবম গ্রেড ধরে একটি যৌক্তিক পদসোপানসহ স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠন করা। বিষয়টি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখাকে বেশ কয়েকবার জানানো হলেও আলোর মুখ দেখেনি। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর বর্তমানে বিপুল সংখ্যক মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি কলেজ, সরকারি কলেজ তদারকিসহ অন্যান্য কার্যক্রম চালাতে হিমসিম খাচ্ছে। তাই মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনের কাজে গতি এবং বিদ্যালয় পরিদর্শন ও তদারকি ব্যবস্থা জোরদার, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর প্রস্তাবনা অনুযায়ী ও নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য ‘স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর’ একান্ত প্রয়োজন।
শিক্ষক নেতা মমতাজ খাতুন বলেন, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বঞ্চনার শিকার। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে যোগদান করে অনেক শিক্ষক এখনো সহকারী শিক্ষক, কেউ সিনিয়র শিক্ষক, কেউ সহকারী প্রধান শিক্ষক আবার কেউ প্রধান শিক্ষক। আমাদের চার ভাগে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। শিক্ষকদের টাইম স্কেল দেয়া হচ্ছে না। অগ্রিম বর্ধিত বেতন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলা শিক্ষা অফিসারের ৫০ শতাংশ পদে সিনিয়র শিক্ষকদের পদায়ন পাওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। নন ক্যাডার শিক্ষকদের স্থায়ীকরণ করা হচ্ছে না। শিক্ষকরা মুখ খুলতে পারে না বদলি ভয়ে। আমরা প্রতিনিয়ত বদলির ভয়ে থাকি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুশাসন থাকলেও সরকারি স্কুল শিক্ষকদের পদ আপগ্রেড করা হয় না। তারা চান না বঙ্গবন্ধু কন্যার অনুশাসন বাস্তবায়ন হোক। জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন সেটাও কি চান না।
শিক্ষক নেতারা বলেন, আমাদের সমস্যার কথা বলে না অধিদপ্তর। হয়তো আমরা সমস্যাগুলো সম্পর্কে অধিদপ্তরে জানাই। কিন্তু অধিদপ্তর থেকে সেগুলো মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় না।
তারা আরও বলেন, প্রায় ২৪ হাজার প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে ২০ হাজারের বেশি মাধ্যমিক স্কুল। আর সাড়ে তিন হাজার কলেজ। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রণ করেন সরকারি কলেজ শিক্ষকরা। মাধ্যমিকের আলাদা অধিদপ্তর হলে এবং তার নিয়ন্ত্রণে সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষকরা থাকলে সরকারি স্কুলের সমস্যাগুলো দূর হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে মমতাজ খাতুন বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অবকাঠামোতেই মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এর বাধা অর্থনৈতিক সক্ষমতা নয়, এর বাধা আমলাতান্ত্রিক। শিক্ষকরা কাদের জন্য বঞ্চিত জানতে চাইলে ওই শিক্ষক নেতা বলেন, কলেজ, একমাত্র কলেজ। অপর এক শিক্ষক নেতা বলেন, আমাদের মহাপরিচালক, পরিচালক ও আঞ্চলিক পরিচালক সবাই কলেজ শিক্ষক। আমরা প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়ন চাই।
শিক্ষক নেতারা আরও বলেন, ডিসিরা আমাদের কষ্টের কথা জানেন। কারণ তাদেরকে আমরা আমাদের সমস্যার কথা জানাই। তারা যখন আলাদা অধিদপ্তরের প্রস্তাব করলেন তখন কেনো শিক্ষা সচিবের সঙ্গে দেখা করে কলেজ শিক্ষকরা অধিদপ্তরের অখণ্ডতা রক্ষার দাবি জানালেন? প্রাথমিকে আলাদা অধিদপ্তর হলে আমাদের জন্য কেনো হবে না।
শিক্ষকদের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে ১২ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো, স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বাস্তবায়ন, সহকারী শিক্ষকদের বিদ্যমান পদের আপগ্রেডেশন করে এন্ট্রিপদ নবম গ্রেডে উন্নীতকরণ, সরকারি কলেজের মতো চার স্তরীয় পদসোপান বাস্তবায়ন, বিসিএস রিক্রুটমেন্ট রুলস ১৯৮০ অনুযায়ী বিসিএস সাধারণ শিক্ষা (ক্যাডারভুক্ত) বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখায় কর্মরত সহকারী প্রধান শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের প্রস্তাবিত পৃথক মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে পরিচালক এবং আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালকের পদসহ পরিদর্শন শাখার অন্যান্য সব পদে শতভাগ পদায়ন নিশ্চিত করা।
শিক্ষকদের দাবির মধ্যে আরও আছে, দ্রুত দীর্ঘদিনের বকেয়া টাইমস্কেল, সিলেকশন গ্রেডের মঞ্জুরী আদেশ প্রদান, বিভিন্ন সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষকদের ব্যাচভিত্তিক নিয়মিত পদোন্নতি নিশ্চিত করা, ২০১০ (অংশ) ও ২০১১ ব্যাচের সহকারী শিক্ষকদের সিনিয়র শিক্ষকের শূন্য পদে পদোন্নতি দেয়া, সিনিয়র শিক্ষকদের উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের ৫০ ভাগ পদে দ্রুত বিধি মোতাবেক পদায়ন নিশ্চিত করা, কর্মরত সিনিয়র শিক্ষকদের সহকারী প্রধান শিক্ষক, সহকারী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক ও সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শিকা পদে পদায়ন, দ্রুত নন-ক্যাডার শিক্ষকদের স্থায়ীকরণ নিশ্চিত করা, অগ্রীম বর্ধিত বেতন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার দ্রুত নিরসন এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের জন্য সুষ্ঠু ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ বদলি নীতিমালা বাস্তবায়ন।