গত ২৫ জানুয়ারি দৈনিক শিক্ষাডটকমের সংবাদ শিরোনাম ছিলো ‘এমপিওভুক্ত স্কুল জাতীয়করণের পক্ষে প্রতিমন্ত্রী’। খবরে বলা হয়েছে, এমপিওভুক্ত স্কুল সরকারিকরণ জরুরি মনে করেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি। তিনি বলেন, ‘এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি টাকা পাচ্ছে। আরেকটু বেশি টাকা খরচ করে এসব প্রতিষ্ঠানকে সরকারিকরণ করা যেতে পারে। বিষয়টি বিবেচনা করতে শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে আয়োজিত এক সভায় এমন মন্তব্য করেন তিনি’।
এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে শিক্ষামন্ত্রীকে প্রতিমন্ত্রীর অনুরোধে আমরা শিক্ষা জাতীয়করণের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি এমপির বক্তব্যে তিনি যে লাখ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর কষ্টের কান্না সবচেয়ে বেশি টের পান তারই প্রতিফলন এবং আন্তরিক অভিব্যক্তির স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। এমন আশা, আহ্বান, অনুরোধের মধ্যে শিক্ষা জাতীয়করণের ফিকে হয়ে যাওয়া সম্ভবনা টিকে রইলো। সত্যিকারের গণমানুষের নেতাদের কাছে যে দাবি করতে হয় না, চাওয়া লাগে না-প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে তা-ই প্রমাণিত হলো আরেকবার।
প্রসঙ্গত, স্মরণীয়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহিদ তাজউদ্দীন আহমদের সুযোগ্য কন্যা প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি ইতোমধ্যেই ‘কাপাসিয়ার উন্নয়নের রূপকার’ অভিধায় নিজের স্থান করে নিয়েছেন। মাতৃমৃত্যু রোধে তার ‘কাপাসিয়া মডেল’ স্বীকৃত ও প্রশংসিত হয়েছে। তার এ উদ্যোগ জাতীয়ভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হলে, তা আন্তর্জাতিক সর্বোচ্চ সম্মান বয়ে আনবে নিশ্চয়ই। মন্ত্রীসভায় স্থান পাওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি পৌঁছেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। এ জন্যই শিক্ষক ও শিক্ষার কল্যাণে তার ভূমিকার দিকে তাকিয়ে আছে সারা দেশ।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সারা দেশে ইতোমধ্যে শত শত স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে তার এ অবদান হাজার বছরেও থাকবে অম্লান-অমলিন। তবে শিক্ষার মনোন্নয়ন, শিক্ষকদের পেশাগত বঞ্চনা ও বৈষম্যের পীড়াদায়ক অধ্যায়ে আজো দিব্যদৃষ্টিতে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটীকা’ গল্পের পণ্ডিতমশাই ভেসে ওঠেন, লেখকের ভাষায় ‘Silence is golden’.
কিছু কিছু স্কুল-কলেজ জাতীয়করণের ফলে অবশিষ্ট বেসরকারি ও এমপিওভুক্তরা সবাই খানিকটা মানসিক হতাশায় ডুবেছেন। এটা অস্বাভাবিক নয়। অনেকের বিষণ্ন ভাবনা-কান্না সবই যেনো এখন ব্যর্থ, ভুল ও নীরব হাহাকার। রূঢ় সত্য হলো: ক. এমপিওভুক্ত স্কুল কলেজ মাদরাসার যেই হোন না কেনো, তিনি প্রিন্সিপাল অথবা পিওন, সবাই একই হারে বাড়িভাড়া পান ১০০০ টাকা! খ. শিক্ষকরা উৎসব ভাতা পান মূলবেতনের ২৫ শতাংশ এবং কর্মচারীরা ৫০ শতাংশ! গ. পদোন্নতি সুযোগ খুবই সীমিত বা প্রায় নেই! ঘ. নেই বদলির অবকাশও! ঙ. পান না পূর্ণাঙ্গ মেডিক্যাল ভাতাও!
এমনি অনেক সত্য বুকে ধারণ করে এমপিওভুক্ত নিরীহ বেসরকারি শিক্ষকরা জ্ঞানের প্রদীপ জ্বেলে যাচ্ছেন নীরবে। অন্যদিকে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বা তার পরিবারের সদস্যদের নাম কিংবা বীরশ্রেষ্ঠদের অথবা জাতীয় নেতানেত্রী, বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের স্মৃতি ও নাম স্কুল-কলেজ জাতীয়করণের যৌক্তিকতা বাড়িয়ে দেয় সত্য। এ কারণে জাতীয়করণ হয়েছে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান। তবে জাতীয়করণের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর বয়স, অবস্থান, ভূসম্পত্তি, আয়, অবকাঠামোগত সুবিধা, ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিবেচনায় আনাও গুরুত্বপূর্ণ।
সব সরকারি অফিস যেমন সদরে থাকে, তেমনি জাতীয়করণেও ‘সদর’কে গুরুত্ব দেয়া দরকার। অথচ জাতীয় বরেণ্য ব্যক্তিত্বের নাম ও স্মৃতি রক্ষায় জাতীয়করণের কারণে, কিছু কিছু উপজেলায় সদরের প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ প্রক্রিয়া হতে বাদ গেছে। উপজেলা সদরের যেসব লব্ধ প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ বঞ্চিত হয়েছে, ওসব প্রতিষ্ঠান জাতীয় নেতাদের নামে নামকরণ করে হলেও জাতীয়করণ করা অধিকতর যৌক্তিক। প্রসঙ্গত, টাঙ্গাইলের কালিহাতি ডিগ্রি কলেজ, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজ, কিশোরগঞ্জের ভৈরব হাজি আসমত কলেজ, গাজীপুর জেলার উপজেলা সদরের দু’টি কলেজ, কালিয়াকৈর ডিগ্রি কলেজ এবং ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে গাজীপুর জেলায় প্রথম প্রতিষ্ঠিত, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ উদ্বোধনকৃত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহিদ তাজউদ্দীন আহমদের স্মৃতিবিজড়িত কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ জাতীয়করণে প্রধানমন্ত্রীর মহতি উদ্যোগ হতে বঞ্চিত রয়েছে।
এ ছাড়া রয়েছে আরো কিছু স্কুল-কলেজ। তবে উপজেলা সদরের বাদ যাওয়া কলেজের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কাজেই, যেসব উপজেলায় সদরের কলেজ জাতীয়করণের প্রক্রিয়ায় আসেনি, সেসব কলেজ জাতীয়করণেমাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি ও শীঘ্র সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় সংশ্লিষ্ট সবাই।
আমার ৩১ বছরের পেশাগত অবস্থানে আমি গর্বিত এবং অনেক বাস্তবতার নীরব সাক্ষী। তবুও, সবার সঙ্গে আমারও প্রত্যাশা ‘শিক্ষা জাতীয়করণ’ বাস্তবায়ন তরান্বিত হবে প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি এমপি মহোদয়ের অনুরোধের মধ্য দিয়ে। আশা করি, তিনি তার প্রচেষ্টা অব্যহত রাখবেন। বিশেষ শুভেচ্ছা, দোয়া ও ধন্যবাদ প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি এমপি মহোদয়।
অন্যদিকে, ০৩ জানুয়ারি ২০২৩, বাংলা ট্রিবিউনের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে ‘দেশের এমপিওভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করলে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে বলে মনে করেন না শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি’।
২১ মে, ২০১৭ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত শিক্ষক-কর্মচারী সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় সাবেক শিক্ষা সচিব ও শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র জাতীয় পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকম’র প্রধান উপদেষ্টা মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমি আমার অবসরের একদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতকালে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কী চাও?’ জবাবে আমি বলি, ‘আমি দু’টি জিনিস চাই। এক. শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করে দিন। দুই. আমাকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দেন যাতে সব অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ সুবিধার টাকা সময়মতো দিতে পারি’। কাজেই, ‘শিক্ষা মানুষের অধিকার; জাতীয়করণ সবার দরকার’।
অথচ ফকির লালনের সুর-বাণী বেজে ওঠে অন্তরে অন্তরে:
‘কবে হবে সজল বরষা?
রেখেছি মন সেই ভরসা...
আমার এই ভগ্ন দশা,
যাবে কত দিন পরে’?
লেখক: বিভাগীয় প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া গাজীপুর