শিশুদের আমরা ছোট মানুষ এবং চিন্তা-চেতনায় আমাদের চেয়ে অনুর্বর মনে করি। শিশুদের আমরা দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যথোপযুক্ত মনে করি না। শিশুরা কি সাদা কাগজ? আসলেই না। আমরা মনে করি শিশুরা কিছু বোঝেন না। কিন্তু আমাদের এ ধারণা সঠিক নয়। একটি শিশুকে যদি আপনি একটা আপেল আর অর্ধেকটা আপেল দেন, শিশু কিন্তু অর্ধেকটা নেবেন না। তার মানে তিনি কিছুটা বোঝেন। ধমক দিলে তার মন খারাপ হয়, আবার একটা সময় তিনিও আপনাকে ধমক দেবেন। চোখের ভাষাও কিন্তু শিশু বোঝেন। আপনি কি ভয় দেখাচ্ছেন নাকি ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন। কোনো বিষয় তার অপছন্দ হলে কান্না বা রাগের মাধ্যমে তার অনুভূতি প্রকাশ করেন। অপরিচিত ব্যক্তির কাছে শিশু যেতে চান না। কারণ, তাকে তিনি নিরাপদ মনে করেন না। মায়ের হাসিতে শিশু হাসে, আবার মায়ের কান্নায় শিশু কাঁদে। শিশুরাও আমাদের মতোই একটি দেহ ও মন নিয়ে গঠিত। তিনি প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার মাধ্যমে নিজেকে পরিবেশে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করেন। শিশুর মধ্যেও অপমান বোধ কাজ করে।
প্রতিটি শিশুরই নিজস্ব একটি সত্তা, আত্ম-মর্যাদা ও সম্মানবোধ আছে। শিশুর আত্ম-মর্যাদায় আঘাত হানে এমন কাজ করা অনুচিত। আমরা অনেক সময় শিশুকে বকাঝকা করি বা গালমন্দ করি, যা শিশুর মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। অনেক সময় আমরা শিশুর পরিবার-পরিজন নিয়ে ঠাট্টা করি। সব শিশুর বোঝার ক্ষমতা ও শেখার ধরন এক নয়। কোনো কোনো শিশু খুব ধীরে শেখে, আবার কোনো কোনো শিশু দ্রুত শেখে । পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কিন্তু ছোট বেলায় ভালো ছাত্র ছিলেন না। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী হয়েছেন। তাই ‘তোর মাথা গোবরে ভর্তি, তোর দ্বারা কিছুই হবে না’-শিশুর সঙ্গে এমন নেতিবাচক আচরণ করা ঠিক নয়। এমন আচরণে শিশু হীনমন্যতায় ভোগে। ফলে, তিনি বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত হন। কঠিন শাসন-বারণও শিশু পছন্দ করেন না। আপনি যা বলেছেন তাকে তাই করতে হবে। অর্থাৎ আপনার কর্তৃত্ব তাকে মানতেই হবে। এমন নীতি থেকে আপনাকে বেরিয়ে আসতে হবে। কখনো কখনো তাকেও প্রাধান্য দিন।
অর্থাৎ শিশুর সঙ্গে নমনীয় নীতি গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয়। তাকে তার মতো করেই বেড়ে ওঠার সুযোগ দিন। অনেক সময় আমাদের সিদ্ধান্তগুলো শিশুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায় যা তার সঙ্গে কখনোই করা উচিত নয়। ভয়, একঘেয়েমিতা এবং দ্বিধা এই তিনটি কারণ একটি শিশুকে ব্যর্থতার দিকে ধাবিত করে। ভয় শিশুদের আগ্রহকে সংকুচিত করে। শেখার আগ্রহ কমিয়ে দেয়। অথচ আমরা প্রায়ই শিশুদের পড়া শিখানোর ক্ষেত্রে শারীরিক শাস্তির ভয় দেখাই। মানসিক আঘাত করি, যা থেকে শিশুর মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হয়। একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তিতে তার একঘেয়েমিতা আসে। আবার পাঠে যদি রস না থাকে, বিষয়ের প্রতি তখন তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং তার একঘেয়েমিতা আসে। তাই আপনার উচিত অনেকক্ষণ পর্যন্ত একই বিষয় না পড়ানো। কোনো বিষয়ে যদি তার আগ্রহ না থাকে ওই বিষয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। আবার কোনো বিষয়ে যদি তার ধারণা স্পষ্ট না হয়, তাহলেও তার শিখন ব্যর্থ হয়। যে কোনো বিষয় শিশুর নিকট সহজ-সরলভাবে উপস্থাপন করুন। আমাদের ভাবনা আর শিশুর ভাবনা একরকম নয়। যেকোনো বিষয়কে শিশুর নিকট তার মতো করেই উপস্থাপন করুন। কোনো বিষয় তার বুঝতে সমস্যা হলে বিভিন্নভাবে তা উপস্থাপন করুন যাতে তার ধারণা সুস্পষ্ট হয় নতুবা শিশুর শিখন ব্যর্থ হবে। শিশু ভুল বা শুদ্ধ যাই করুন, আপনি যদি খুশি হন, তাহলে তিনিও খুশি হন। শিশু কৌতূহল প্রিয়, তার কৌতূহল মেটাতে হবে। বেশি বেশি প্রশ্ন করলে তার প্রশ্ন শুনতে হবে এবং উত্তর দিলে তিনি খুশি হন। আপনি কি তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, নাকি দিচ্ছেন না তা তিনি বোঝেন। তিনি চান আপনি তাকে গুরুত্ব দেন, তার কথা মতো কাজ করেন। সব সময়ই তিনি আপনার কাছে আদর-স্নেহ প্রত্যাশা করেন। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চান। তার বায়না পূরণ করবেন এটি তিনি আপনার কাছে প্রত্যাশা করেন। তার সঙ্গে খেলবেন, গল্প করবেন, তাকে নিয়ে ঘুরতে যাবেন, এমন আচরণ সব সময়ই তিনি প্রত্যাশা করেন। আপনার কাজে তাকে সাহায্য করতে দেবেন, তার কাজে সাহায্য করবেন, প্রত্যেকটি শিশুই এমনটি আশা করেন। আপনি তাকে সাহায্য করতে পারেন ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শনের মাধ্যমে। একমাত্র আপনার ইতিবাচক মনোভাব ও সহযোগিতাই পারে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে তরান্বিত করতে। শিশুকে তার কাজে উৎসাহ দিতে চেষ্টা করুন। উৎসাহ-উদ্দীপনা দিলে শিশু সফল হবে। সবসময় শিশুর প্রতি মনোযোগী হতে হবে, তাহলে শিশু কোনো কিছু করতে বা বলতে উৎসাহিত হবে। বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। আমরা অনেক সময় কিছু কিছু কাজে শিশুদেরকে অংশগ্রহণ করতে দিই না। তারা পারবেন না এই ভেবে। যা শিশুদেরকে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। শিশুর প্রতি আপনার বিশ্বাস ও আস্থা তাকে বহুদূর এগিয়ে দিতে পারে। ইতিবাচক আচরণ তার সফলতায় সহায়ক ভূমিকা রাখে। শিশুকে কৃতকাজের পুরস্কার দিতে হবে, যা তাকে আনন্দিত করে এবং কাজের প্রতি তার স্পৃহাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। শিশুরা কর্মচঞ্চল, তার কর্মচঞ্চলতাকে পছন্দ করুন, যা তার সফলতাকে ত্বরান্বিত করবে। ‘তুমি অনেক ভালো করেছো, খুব সুন্দর হয়েছে, তোমাকে ধন্যবাদ’, এ ধরনের প্রশংসাসূচক বাক্য শিশুর ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলতে সহায়তা করে। প্রশংসাসূচক একটি বাক্য অথবা ছোট্ট একটি পুরস্কার তাকে অনেক আনন্দিত করে। আনন্দের সংমিশ্রণে শিখন সফল হয়। প্রত্যেক শিশু শেখার ধরনে তার নিজস্বতা থাকে। তারা কখন কী শিখছে তা বোঝা মুশকিল। কারণ, চলার পথে প্রত্যেকটা অভিজ্ঞতা থেকে তারা শেখেন। শিশুরা দেখেন, শোনেন, অনুকরণ করেন এবং অনুসরণ করেন আর এর মাধ্যমে শেখেন, কেউ আবার বারবার চেষ্টার মাধ্যমে শেখেন। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, আপনি বেশি কিছু জানেন না কী শেখাবেন। তারপরও তিনি আপনার কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখেন। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তাই তিনি বড়দের কথা ও কাজকে অনুকরণ করেন। পরিবারের কে কীভাবে কথা বলেন, কীভাবে হাঁটেন তা শিশু বলতে পারেন। আর শিশু যখন আনন্দ পান তখনই তার শিখনটা দ্রুত ঘটে। উৎসাহ পেলে তাদের শেখার আগ্রহ বহুগুণ বেড়ে যায়। পরিবার এবং আশপাশের অভিজ্ঞতাই শিশুর শিখনের মূলভিত্তি। এজন্য পরিবারের সদস্যদেরকে সতর্কভাবে পারিবারিক কাজকর্ম পরিচালনা এবং রীতিনীতি মেনে চলা উচিত। ভালো বা খারাপ যাই করুক আপনি তার পাশে থাকুন। সবসময় তার ওপর বিশ্বাস রাখুন। আমরা যা করি শিশুরা কিন্তু তাই করেন। যা বলি তা অনেক সময়ই শুনতে চান না। তাই শিশুর নিকট নিজেকে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করুন। কোনো কাজে কিছু অর্জন হোক বা না হোক তাকে প্রশংসা করুন। প্রশংসা করার মাধ্যমে তাকে বিকশিত হতে সাহায্য করতে পারেন। শিশুর শেখার ধরন অনুযায়ী তাকে শিখতে সাহায্য করুন। আপনি যে রকম পছন্দ করেন সে রকম নয়। কারণ, প্রত্যেক ব্যক্তিরই শেখার ধরন আলাদা। শিশুদের পছন্দ ও অপছন্দকে আপনি প্রাধান্য দিন। এটি তাদের আত্ম-সম্মান ও আত্মবিশ্বাস তৈরি করবে। শিশুদের একটা নিয়মের মধ্যে রাখুন, তাহলে তারা নিয়মানুবর্তিতা শিখবে। তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন, এতে তারা সহানুভূতি শিখবেন। এটি পরবর্তী জীবনে তাকে অসাম্প্রদায়িক করে তুলবে। শিশুর সঙ্গে মিথ্যা বলা পরিহার করুন এবং নীতি কথা শুনান, যা ভবিষ্যতে তাকে নীতিবান করে তুলবে। শিশুকে চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সাহায্য করুন, এটি তাকে সফল হতে সাহায্য করবে। নিজেকে অভিভাবক নয় শিশুর সহায়ক ভাবুন, বন্ধু ভাবুন।লেখক : মোহাম্মদ আবদুল মোতালেব, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, ফেনী সদর, ফেনী