এ এক অসম্ভব গ্রন্থিহীন সময়ের যাত্রী আমরা। অলীক কুনাট্য রঙ্গে ভরা চারপাশ। সত্যের চিত্র তুলে ধরতে গেলে অজানা শংকায় দুরুদুরু কাঁপে বুক, অস্থির সময়ের খরোত্তাপে শুকিয়ে যায় কলমের কালি। সত্যের সোজাপথে চলতে পারে না লেখার লাইনগুলো, মিথ্যে-মেকির গোপন পথে চলে এঁকেবেঁকে, সর্পিল। কবিতা হয়ে ওঠে ছন্দহীন এক গদ্যবিশেষ।
আজকাল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুকের গহিন থেকে, মরহুম শাহ আব্দুল করিমের মতো গাইতে হয় ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।‘ তবে অনেক অসুন্দর দিনের মধ্য থেকে এখনো মাঝে মাঝে হঠাৎ করে এক একটি সুন্দর দিন উঁকি দিয়ে বের হয়ে আসে মেঘে ঢাকা সূর্যের উঁকি দেয়ার মতোই এখনো এমন কেউ কেউ বেঁচে আছেন যাদের দেখা পেলে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে ইচ্ছে করে, যাদের সান্নিধ্যে দিনটি সত্যি অসম্ভব রকমের সুন্দর হয়ে ধরা দেয়। সম্প্রতি ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘কালি ও কলম’ আয়োজিত (২০ বছরপূর্তি উপলক্ষে) ৩ দিনব্যাপী সাহিত্য সম্মেলনে দুজন ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক এবং আচারনিষ্ঠা আমাকে বিমুগ্ধচিত্তে স্মরণ করিয়ে দিলো সেই ছোটবেলাকার মুখস্থ করা কবিতার লাইনগুলো-
‘বাদশাহ আলমগীর
কুমারে তাহার পড়াইতো এক মৌলভী দিল্লীর।
একদা প্রভাতে গিয়া
দেখেন বাদশাহ শাহাজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদ আনত নয়নে…।’
সেখানে অভ্যাগত সুধীজনের মাঝে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং প্রফেসর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, যাদের সম্পর্ক ছাত্র-শিক্ষক ও পরবর্তীকালে সহকর্মী এবং বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। লক্ষ করলাম প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মঞ্চের কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রফেসর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সশ্রদ্ধ সালাম করলেন, একইভাবে প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম যখন বক্তৃতা শেষ করে মঞ্চ থেকে নামছেন তখনো প্রফেসর মনজুরুল দাঁড়িয়ে তার শিক্ষককে সালাম করে তার আসনে বসিয়ে দিলেন। প্রফেসর মনজুরুল অত্যন্ত সুবক্তা কিন্তু তিনি তার নিজের বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে বললেন, আমি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম স্যারের কথা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। কী অপূর্ব শ্রদ্ধাবোধ! এই না হলে গুরুশিষ্য, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক? প্রবীণ এই অধ্যাপক দুজনের কাছে কি আমাদের মাথা নোয়াবার কথা নয়? উল্লেখ্য, এই মহান শিক্ষকদের খ্যাতি শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয় বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ দুর্ভাগ্যের বিষয় আমরা তাদের কাউকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে দেখতে পাইনি। কারণ, তারা নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে কখনো আপোষ করতেন না, ক্যাম্পাসের নোংরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকতেন, ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিতেন না এবং মেরুদণ্ড সোজা করে ন্যায়ের পক্ষে নিজেদের শক্ত অবস্থান জানিয়ে দিতেন। বাস্তব সময়টা নীতিবানদের প্রতিকূলে, কাজেই এই শিক্ষাগুরুদেরকে আমরা কখনো ভিসি হিসেবে দেখতে পাইনি বা তাদেরকে ওই পদে বহাল করা হয়নি। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি, যিনি এমনকি শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা কথাটাও বলতে পারেন না (ইংরেজির কথা না হয় বাদই দিলাম) তাকেও বহাল করা হয়েছিলো ওই পদে, ওই চেয়ারে রাখা হয়েছিলো বছরের পর বছর। সুশাসন নয়, গবেষণা নয়, এখন মহাধুমধামে চলছে সেলফি কালচার ও ফেইক ডেমনস্ট্রেশন, চলছে নিজেকে জাহির করবার এক অশুভ প্রতিযোগিতা।
যাইহোক, সেদিন সকালের কথা বলছি। সায়েন্স ল্যাবের পাশ দিয়ে অফিসে যাওয়ার পথে যে দৃশ্য প্রতিদিন দেখি, সেদিন সে দৃশ্যে দেখে আমার চিন্তায় যেনো নুতন মাত্রা যোগ হলো। সায়েন্স ল্যাবের পাশের একটি কলেজের (স্কুল ও কলেজ) প্রবেশমুখের কিছু দূরে প্রতিদিনই প্রায় শ’খানেক ছাত্রকে দেখতে পাই ক্লাস শুরুর আগে ফুটপাত এমনকি মেইন রোডের বেশ খানিকটা দখল করে বাম হাতে চায়ের কাপে চুমুক এবং ডান হাত দিয়ে সিগারেট ফুঁকছে, এ যেনো সিগারেট-মেলার এক মহোৎসব। কেউ আবার ই-সিগারেট নামক পশ্চিমা ভদ্দরলোকি সিগারেট থেকে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ছেন নাকমুখ দিয়ে, আর তাদের মুখ দিয়ে যে ভাষা বের হচ্ছে তা রিকশা-ভ্যান চালকদের চেয়ে মোটেই উন্নত নয়। আজকে দেখলাম তাদের সঙ্গে এই সাত-সকালে যোগ দিয়েছেন জনা বিশেক মাস্তান অথবা এলাকার বড় ভাই, অদূরেই পুলিশ সতর্ক পাহারায় কারণ এরা প্রায়শই পাশের আরেকটি কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ওরা চা-বিড়ি সেবন করে সেখানে সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয় রিকশাওয়ালাদের মলমূত্র ত্যাগের এক উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা, প্রস্রাবের সঙ্গে নিসৃত অ্যামোনিয়ার ঝাঁঝাল গন্ধে ওপাশ দিয়ে যাওয়াটাই দুষ্কর হয়ে উঠে। নাকের মাস্কটি টাইট করে লাগিয়েও উৎকট গন্ধ থেকে রেহাই মেলে না, অথচ ওরা মহানন্দে ওখানে দাঁড়িয়েই বিড়ি উৎসব পালন করে যাচ্ছে নিয়মিত। রুচিবোধ কখনো ওদের বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। ওই কলেজেরই কিছু শিক্ষক সে পথ অতিক্রম করেন মাথা নিচু করে, মাস্ক দিয়ে মুখটা ভালো করে আড়াল করে যাতে তাদের গুণমুগ্ধ ছাত্রদের দৃষ্টিবিভ্রম ঘটে।
শিক্ষকেরা নিরুপায়, তারা খুব ভালো করেই জানেন তাদের এই মহান কাজে বাধা দিলে বা প্রতিবাদ করলে ওই গুণধর ছাত্ররা শিক্ষকের কী হাল করে ছেড়ে দেবে। বেশ ক’বছর আগে উত্তরবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা প্রকাশ্য দিবালোকে এক শিক্ষককে দিগম্বর করে দিল আবার সেখান থেকে তিন কিলো দূরে একটি সরকারি পলিটেকনিকের অধ্যক্ষকে কনকনে শীতের মধ্যে পুকুরের পানিতে চুবালো, কর্মচারীরা উদ্ধার না করলে তিনি হয়তো মারাই যেতেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাপঞ্জির সাতকাহন আর নাইবা গাইলাম।
কেনো এমন হচ্ছে? শুধু কি ছাত্ররাই দায়ী এসব ঘটনার জন্য? এ থেকে উত্তরণের পথ কি খুবই দুর্গম? কম কথায় বলা যেতে পারে পুঁজিবাদের ব্যাপক উত্থান এবং নব্য-সামন্তবাদের জন্মই এই নাজুক অবস্থার সৃষ্টিকর্তা। কার্লমার্ক্স ও লেলিনের আত্মাকে নির্বাসন দিয়ে পুঁজিবাদ গ্রাস করেছে সারা বিশ্বকে। শিক্ষা, সমাজ ও রাজনীতি এখন পুঁজিবাদের করালগ্রাসে। পুঁজি যার মুল্লুক তার। অতএব, পুঁজিবাদীরাই এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন সারা বিশ্বের সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতিকে এবং প্রজ্বলিত অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে প্রযুক্তির অপব্যবহার। আরো একটি ভয়ংকর প্রযুক্তি ধীরে ধীরে পাখা মেলে এগিয়ে আসছে যার নাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এ আই)। এটির ব্যাবহার নিয়ন্ত্রিত না হলে মানবজাতির জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ দুঃসময়, মহাবিপদ।
পরিস্থিতির উত্তরণ এবং উন্নয়ন খুবই সহজ যদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থকে উপেক্ষা করে যে যার অবস্থানে থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হন, আত্মসম্মান এবং মর্যাদা সম্পর্কে সজাগ থাকেন। তৈল-কালচার ইদানিং প্রশাসনের সর্বস্তরে এক সংক্রামক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। নমনীয় মেরুরজ্জুকে ঋজু করতে প্রয়োজন স্বশিক্ষা যা অধিকাংশেরই নেই। স্বশিক্ষার জন্য প্রয়োজন সিলেবাসের বাইরে গিয়ে অধ্যয়ন, জ্ঞানজগতে বিচরণ এবং আলোকিত মানুষের সাহচর্য লাভ। প্রশাসনে চেইন অব কমান্ড দ্রুত ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি। প্রশাসনে ডিসিপ্লিন, ইউনিটি অব কমান্ড এবং ইউনিটি অব ডিরেকশন না থাকলে সেই প্রশাসন মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে শুধু যুগোপযোগী কারিকুলাম প্রণয়নে কোনোই উপকার মিলবে না যতোক্ষণ না ক্লাসরুম, শিক্ষাদান পদ্ধতিকে আকর্ষণীয় করার জন্য শিক্ষকদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য করে তোলা হয়। আর এ জন্য সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে শিক্ষকদেরকেই, আকাশ থেকে জিবরাইল ফেরেশতা নেমে আসবে না শিক্ষকদের জন্য কোনো ঐশী বাণী নিয়ে। যতোদিন পৃথিবী নামক গ্রহটি টিকে আছে, মহাকাশের ওই সূর্যটাও মাথার ওপরে আছে, ততোদিন আশা করতে অসুবিধে নেই যে আঁধারের অবসান ঘটিয়ে দিনের আলো প্রস্ফুটিত হবেই হবে, শুধু সময়ের অপেক্ষা।
লেখক: যুগ্ম-পরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।