শূন্যপদ পূরণে কর্তৃপক্ষের অনীহা : সোয়া দুই লাখ চাকরিপ্রার্থীর হাহাকার - দৈনিকশিক্ষা

সচিব সভা আজশূন্যপদ পূরণে কর্তৃপক্ষের অনীহা : সোয়া দুই লাখ চাকরিপ্রার্থীর হাহাকার

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শূন্যপদের দুই দিক। একদিকে কর্তৃপক্ষ, অন্যদিকে বেকার। দুই পক্ষ দুই মেরুতে অবস্থান করে। কর্তৃপক্ষ শূন্যপদ পূরণে বরাবরই অনীহা দেখায়। আর চাকরিপ্রার্থীরা হাহাকার নিয়ে অপেক্ষা করে।

এই দুই পক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধের কাজটি ঠিকমতো করতে পারছে না সরকার। জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ যখন বেকার, তখন শূন্যপদ পূরণে যে তৎপরতা দেখানো দরকার তা অনুপস্থিত। দীর্ঘদিনে এই জায়গাটিতে কোনো দক্ষতাও গড়ে ওঠেনি।

নতুন মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার দায়িত্ব নিয়েই যেসব কাজে গুরুত্ব দিয়েছেন তার মধ্যে শূন্যপদ পূরণ অন্যতম। প্রশাসনের রেওয়াজ হচ্ছে তিন থেকে ছয় মাস পর সচিব সভা করা। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের এ সভায় প্রশাসনের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনার আলোকে নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কিন্তু নতুন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছয় মাস অপেক্ষা করতে চাচ্ছেন না। এ কারণে সচিব সভা হওয়ার মাত্র ৩০ দিনের মধ্যেই তিনি নতুন করে সচিব সভা ডেকেছেন। আগের সচিব সভাটি ছিল বিদায়ী মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের অধীনে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সভা। এবারের সচিব সভাটি হবে বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব কীভাবে প্রশাসনকে সাজাতে চান তার বার্তা দেওয়ার সভা।

আজ সোমবার অনুষ্ঠেয় সভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের শূন্যপদে নিয়োগের বিষয়ে আলোচনা। বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও অধীনস্ত দপ্তরের শূন্যপদ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য সচিবদের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা  বলেন, বৈঠকে শূন্যপদ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন দর্শন বাস্তবায়নে সচিবদের ভূমিকা এবং ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে মন্ত্রণালয়গুলোর ভূমিকা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হবে। তবে শূন্যপদ কীভাবে পূরণ করা যায় সেটাই মুখ্য। সচিবদের শূন্যপদ সংক্রান্ত সব তথ্য সঙ্গে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এছাড়া শূন্যপদের তথ্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগও সংগ্রহ করেছে। সরকারের মোট শূন্যপদের সংখ্যা ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৬৩৭। এর মধ্যে সাতটি মন্ত্রণালয়ের অধীনেই ২ লাখ ৩০ হাজার ৩৯৬।

সবচেয়ে বেশি শূন্যপদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের, ৬৬ হাজার ৫৩৪টি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শূন্যপদ ৫৬ হাজার ১৩৮, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৩০ হাজার ৫৯১, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৭ হাজার ৬১০, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ২২ হাজার ৭৭৬, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ১৪ হাজার ৬২৪, শিল্প মন্ত্রণালয়ের ১২ হাজার ১২৩, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ১১ হাজার ১০২।

সরকারের মোট ৪৪টি মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে কিছু মন্ত্রণালয়ের একাধিক বিভাগ রয়েছে। সাধারণত একজন মন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রণালয় পরিচালিত হলেও প্রতিটি বিভাগের আলাদা সচিব রয়েছেন। এসব সচিবই আজকের সচিব সভায় অংশ নেবেন।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, যে সাত মন্ত্রণালয়ে শূন্যপদ বেশি সেগুলোতে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হবে। বাকিগুলো তদারকির আওতায় থাকলেও কম গুরুত্ব পাবে। আর খেয়াল রাখা হবে এগুলোতে জনবল নিয়োগ করতে না করতেই যেন আবারও পদ শূন্য না হয়ে যায়। সংস্থাগুলো সাধারণত শূন্যপদ জমিয়ে রাখে। অর্থাৎ একসঙ্গে অনেক শূন্যপদ হলে তারা নিয়োগের উদ্যোগ নেয়। এই অবস্থা থেকেও বের হয়ে আসা যাবে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের শূন্যপদের বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, শূন্যপদ পূরণে কৃষি মন্ত্রণালয় তৎপর। কৃষির এত বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী যে, একদিকে লোক নেওয়া হয়, অন্যদিকে অবসরে চলে যায়। এসব শূন্যপদে যেন কোনো শূন্যতার সৃষ্টি না হয় সেটা আমরা বরাবরই লক্ষ রেখেছি।

দেশে যে পরিমাণ চাকরিপ্রত্যাশী তার তুলনায় চাকরির সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। শ্রম মন্ত্রণালয়ের মতে, প্রতি বছর ২০ থেকে ২৫ লাখ জনশক্তি শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এই কর্মসংস্থানের মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি আর ৯৫ শতাংশ বেসরকারি খাতের। উচ্চশিক্ষা শেষ করে অনেকে সরকারি চাকরির জন্য অপেক্ষা করেন বছরের পর বছর। একাধিক বিসিএস এবং একের পর এক সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৩৪ শতাংশ আর স্নাতক পর্যায়ে এই হার ৩৭ শতাংশ। মহামারীর আগে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। আইএলও’র এ বছর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলে মহামারীর পর বেকারের সংখ্যা মহামারীর আগের তুলনায় ৫০ লাখ বেড়েছে।

২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল চাকরির সুবিধা পরিবারে পরিবারে পৌঁছে দেওয়া। যেখানে রাজস্ব খাতভুক্ত পদের বড় সংখ্যা শূন্য থাকে, সেখানে ক্ষমতাসীন দলের এ প্রতিশ্রুতি যে পূরণ হয়নি তা সহজেই অনুমান করা যায়। বছরে সরকার গড়ে ৫০ হাজার শূন্যপদ পূরণ করতে পারে। গত অর্থবছরে সরকার ৫১ হাজার ৯০৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে। মহামারীর কারণে তার আগের অর্থবছর এই সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৫৫৩, যা অর্ধেকেরও কম।

বিপুলসংখ্যক পদ শূন্য থাকার পরও সরকার শূন্যপদে জনবল নিয়োগ করতে পারে না। এই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তরের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা শূন্যপদ পূরণে আগ্রহী হন না। জনবল নিয়োগ করতে গেলে ‘বদনাম’ হওয়ার আশঙ্কায় তারা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেন। বদনাম হলে আরও ওপরের পদে পদোন্নতি পাওয়ার আশা ভঙ্গ হতে পারে এ কারণে কর্মকর্তারা নিয়োগে আগ্রহ হারান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সচিব বলেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলেই সবার আগে ডেকে পাঠান মন্ত্রী। তিনি জানতে চান নিয়োগে তার সুপারিশমতো কত শতাংশ নেওয়া হবে। অনেক ক্ষেত্রেই মন্ত্রীর কথা রাখতে গেলে আর কোনো প্রার্থী নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ থাকে না। কখনো কখনো মন্ত্রীরা শূন্যপদের চেয়ে বেশিসংখ্যক প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য চাপ দেন।

কিন্তু সচিবের বক্তব্যের ঠিক উল্টো অভিযোগ করেন মন্ত্রীরা। গত মাসে সচিবালয়ে চার নম্বর ভবনে গিয়েছিলেন একজন চাকরিপ্রার্থী। নওগাঁ থেকে আসা ওই প্রার্থী একটি অধিদপ্তরে জনবল নিয়োগের সর্বশেষ অবস্থার খবর নিতে গিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে তিনি মন্ত্রীর রুমে পৌঁছে যান। শূন্যপদে নিয়োগের খবর নিতে মন্ত্রী ফোনে কথা বলেন ওই অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে। ফোনে কথা বলা শেষ করে মন্ত্রী উপস্থিত প্রতিনিধিকে জানান, টাকা খাওয়ার হিসাব চূড়ান্ত করতে পারছেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত টাকার হিসাব না মিলবে ততক্ষণ নিয়োগ আটকে রাখেন আমলারা।

মন্ত্রী-সচিবদের ধাক্কাধাক্কিতে একদিকে শূন্যপদ বাড়ছে। অন্যদিকে বেকারদের হাহাকার দীর্ঘতর হচ্ছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একজন সাবেক শিক্ষার্থী জানান, অনেকে মনে করেন ইংরেজিতে পাস করলেই চাকরি পাওয়া যায়। আসলে তা নয়। মাস্টার্স করতে করতেই ২৭ বছর পার হওয়া ওই তরুণ বলেন, বিশ^বিদ্যালয় শেষ করে চেষ্টা করলে দুটো বিসিএস দেওয়া যায়। এছাড়া নন-ক্যাডার চাকরিই ভরসা। কিন্তু তিন বছরে কত আর দরখাস্ত করা যায়। দরখাস্ত করলেই লিখিত পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ কার্ড আসে না। আবার অনেক সময় একদিনে পাঁচটি লিখিত পরীক্ষারও চিঠি এসেছে। আর ক্যাডার পদের সংখ্যা কম থাকায় এতে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়। এসব কারণে বেসরকারি চাকরিই ভরসা। সেই বেসরকারি চাকরি করতেও ইদানিং ঘুষ দিতে হয় বলে তিনি অভিযোগ করেন।

নিজে কিছু করছেন না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুব উন্নয়নে গিয়েছিলাম। তারা এক লাখ টাকা ঋণ দেবে। কিন্তু তারা সাপোর্ট হিসেবে জমির দলিল চায়। আমি জমির দলিল পাব কী করে। আমার বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় তো আমার নামে কোনো জমি হবে না।

বাংলাদেশ মধ্য ও উন্নত আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছে। দেশে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ের অভাব নেই। কিন্তু সমস্যা হলো এই তরুণদের উপযুক্ত শিক্ষা নেই। ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষায়ও তারা দক্ষ নন। এই কারণে দেশীয় তরুণদের বাদ দিয়ে বিদেশিদের নিয়োগ দিতে হচ্ছে। এসব বিদেশি নাগরিক বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছেন।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘সরকারের শূন্যপদ পূরণ করতে হলে ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছাড়া এসব পদ পূরণ করা সম্ভব হবে না। কার বদনাম হবে বা কে টাকা ঘুষ নিচ্ছে এগুলো উপেক্ষা করে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুধু সিদ্ধান্তেই চলবে না নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তা না হলে বিপর্যয়ের সময় শুনতে হবে জনবল নেই। নারায়ণগঞ্জের হাশেম ফুডের কারখানায় দীর্ঘ সময় আগুন জ¦লছিল। এ আগুন দ্রুত নেভানো গেল না দক্ষ জনবলের অভাবে।

সূত্র : দেশ রূপান্তর

বিসিএসে আনুকূল্য পেতে যেচে তথ্য দিয়ে বাদ পড়ার শঙ্কায় - dainik shiksha বিসিএসে আনুকূল্য পেতে যেচে তথ্য দিয়ে বাদ পড়ার শঙ্কায় ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দেশে আদর্শ ও নীতিবান শিক্ষকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে: উপাচার্য এ এস এম আমানুল্লাহ - dainik shiksha দেশে আদর্শ ও নীতিবান শিক্ষকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে: উপাচার্য এ এস এম আমানুল্লাহ জাল সনদে চাকরি করছেন এক বিদ্যালয়ের সাত শিক্ষক - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছেন এক বিদ্যালয়ের সাত শিক্ষক কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক ছাত্র আন্দোলনে নি*হত ৯ মরদেহ তোলার নির্দেশ - dainik shiksha ছাত্র আন্দোলনে নি*হত ৯ মরদেহ তোলার নির্দেশ এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0088920593261719