শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শেকৃবি) সিনিয়রদের বাদ দিয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের হলে তুলেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন গণরুমে থাকলেও নবনির্মিত দুটি হলে সদ্য ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের উঠিয়ে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন সিনিয়ররা।
রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) এক শিক্ষার্থী তিন বছর গণরুমে থাকার কষ্টের বর্ণনা দিয়ে সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘আচ্ছা, গণরুমে বেড শেয়ার করে থাকা কোনো ছেলের যদি মৃত্যু হয়, আর তার যদি কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকে, তাহলে ভার্সিটি কবরটা দিতে দেবে? নাকি সেখানেও কবর শেয়ার করতে হবে?’
ওই শিক্ষার্থী আরও লেখেন, তিন বছর ধরে গণরুমে থাকি। একটা সময় ভালো লাগতো, এখন আর লাগে না। ওয়াশরুমে যেতে হলে পুরো ব্লক ঘুরে যেতে হয়, একটু কাপড় শুকাবো, সেই জায়গাও নেই। পড়ার জন্য একটা টেবিল নেই। রিডিংরুম নেই। এসব দুঃখ কাকে বলবো? প্রশাসন? সিনিয়র ভাই? শিক্ষক? আর কোনো আশা দেখি না। হেরে গেছি।
‘আজকে মনে হলো আয়োজন করে আমাদের কাপড় খুলে বের করে দিলো। কতজন আমার দিকে তেড়ে আসলো। আমি কখনো কাউকে অসম্মান করতে শিখিনি। যদি কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন আমাকে মাফ করে দিয়েন। আমার কোনো সিনিয়র নেই কোনো জুনিয়র নেই। অর্ধেকটা ভার্সিটি জীবন কাটিয়ে দিয়েছি গণরুমে বাকিটাও কাটিয়ে দিতে পারবো।’
ভুক্তভোগী আরেক শিক্ষার্থী লিখেছেন, আমরা ১৯-২০ সেশনে ভর্তি হয়েছি, এখন পঞ্চম সেমিস্টার শুরু হতে চলেছে। গত তিন বছর ধরে কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলের ১১৮ ও ১১৯ নম্বর গণরুমে অস্বাস্থ্যকর ছাত্রজীবন পার করছি। সিট সংকট সমাধানে সদ্য চালু হওয়া শেখ লুৎফর রহমান হলে গণরুমে থাকা ছাত্রদের স্থানান্তরের পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
তিনি আরও লেখেন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম হল প্রশাসন গণরুমে আছি তার সত্যতা যাচাইপূর্বক আমাদের নামের তালিকা প্রকাশ করে। হল প্রশাসনের নির্দেশ মোতাবেক নতুন হলে উপস্থিত হলেও নানা নাটকীয়তার মাধ্যমে আমাদের সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়। গণরুমের অন্য সবারই নতুন হলে যাওয়ার সুযোগ হলেও আমাদের হয়নি। তবে ছাত্র ছাত্র কিসের বৈষম্য?’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শেকৃবিতে উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে ৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে ছাত্রীদের জন্য শেখ সায়েরা খাতুন হল এবং ৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ছাত্রদের জন্য শেখ লুৎফর রহমান হলের কাজ শেষ হয়েছে বহু আগে। তবে লোকবল সংকটের অজুহাতে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল হল দুটি।
শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটের বিষয়টি তুলে ধরে গত ডিসেম্বরে পড়ে আছে ৮০ কোটির হল, আবাসন সংকটে শিক্ষার্থীরা সহ দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও তাতে কর্ণপাত করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরপর সংশ্লিষ্ট হল দুটির জন্য কোনো লোকবল নিয়োগ না হলেও গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক শ্রেণির ওরিয়েন্টেশনের দিনই নবীন শিক্ষার্থীদের নতুন হল দুটিতে কক্ষ বরাদ্দ ও সিঙ্গেল সিট দেয় প্রশাসন।
শেখ লুৎফর রহমান হলে দেখা যায়, ১০তলা হলটির ৭তলা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা থাকছেন। প্রতিটি কক্ষে চারজন করে প্রথমে ৮১ ব্যাচ (নবীন) এবং পরে অন্য হলের গণরুমে থাকা ৮০ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কক্ষ বণ্টন করা হয়। অন্যদিকে ৭৯ ব্যাচের বড় একটি অংশ এবং ৭৮ ব্যাচের কিছু শিক্ষার্থী এখনো অন্য হলগুলোতে ডাবলিং (এক খাঁটে দুজন) করে থাকছেন। এমনকি একটি কক্ষে ৮-১০ জন করে থাকারও তথ্য মিলেছে। একই চিত্র মেয়েদের হলেও।
নজরুল হলের শিক্ষার্থী রাজিউর রহমান বলেন, ২০১৯ সালে ভর্তি হওয়ার পরে গণরুমেও যায়গা না পেয়ে বেশ কিছুদিন থেকেছি টিএসসিতে। তারপর নজরুল হলের ১১৮নং গণরুমে সিট পেলেও এক সিটে দুজন থেকেছি ২০২১ পর্যন্ত। পরে ২০২২ সালে ১১৯নং গণরুমে ছিলাম সেখানেও ডাবলিং। বর্তমানে এখনও নজরুল হলের ১০৯নং গণরুমে জুনিয়রদের সঙ্গে আছি। চার বছর ধরে আমাদের গণরুমে রেখেই নতুন ব্যাচকে কিভাবে সিঙ্গেল সিট দিচ্ছে প্রশাসন তা আমরা জানি না। কেন আমাদের সঙ্গে এই বিমাতাসূলভ আচরণ? আমরা কি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয়?
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শেখ লুৎফর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আনিসুর রহমান বলেন, ‘সমস্যা একদিনে সৃষ্টি হয়নি, কাজেই সমাধানও এক দিনে হবে না। সবাই সিঙ্গেল সিট পাবে, একটু সময় দিতে হবে।’
জ্যেষ্ঠদের রেখে নবীনদের সিঙ্গেল সিট বরাদ্দে অগ্রাধিকার যৌক্তিক কি না- জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতি ও কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলের প্রাধ্যক্ষ কামাল উদ্দিন বলেন, ‘এ বিষয়ে একটু জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, এর বেশি কিছু বলতে পারব না।’