ষোল আনাই ফেরত পেলেন শিক্ষা সচিব আবদুর রশিদ - দৈনিকশিক্ষা

ষোল আনাই ফেরত পেলেন শিক্ষা সচিব আবদুর রশিদ

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পালন করা এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার গত মঙ্গলবার তার ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘শেখ আবদুর রশীদের ২০০৯ সালে সচিব এবং ২০১৫ সালে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হওয়ার কথা ছিল। তখন গায়ের জোরে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছিল।’ গতকাল বুধবার রাতে যোগাযোগ করা হলে আবদুল আউয়াল মজুমদার জানান এটা তারই ফেসবুক পোস্ট। কেন তিনি এ ধরনের পোস্ট দিলেন জানতে চাইলে বলেন, ‘এটা মানি লোকের মান পাওয়ার একটা উদাহরণ। মেধাবী মানুষের উপযুক্ত জায়গায় পৌঁছানোরও। হয়তো অদৃষ্টবাদের খেলাও রয়েছে এখানে। তা না হলে চাকরি শেষে অবসর থেকে ফিরিয়ে এনে শেখ আবদুর রশীদকে কেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব করা হবে।’বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। 

যদিও ভাগ্য নয়, নিয়ম স্বাভাবিক গতিতে চললে শেখ আবদুর রশীদ সরকারের বেসামরিক কর্মকর্তাদের শীর্ষ পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিব হতেনই। কারণ তিনি তার ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের মেধা তালিকায় ছিলেন নম্বর ওয়ান। আর সব ক্যাডারের সম্মিলিত মেধা তালিকায় ছিলেন ৪ নম্বরে। তার ব্যাচের মেধা তালিকার ১৫তম স্থানে থাকা মোহাম্মদ শফিউল আলমকে টেনে ওপরে তুলে করা হয় মন্ত্রিপরিষদ সচিব, পরে ওয়াশিংটনে পাঠানো হয় বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক পদে। যদিও একই ব্যাচে ৯ নম্বরে থাকা সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম মো. শহীদ খানের কপালে বয়সের ফেরে জোটেনি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পদ। একই রকম ভাগ্যবরণ করেছেন সাবেক সচিব আবদুর রব হাওলাদারও।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অবসর থেকে ফিরিয়ে গত মঙ্গলবার শেখ আবদুর রশীদকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব করে অন্তর্বর্তী সরকার। তার আগে তাকে শিক্ষা সচিব করা হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানা চেষ্টা করেও আবদুর রশীদের মান কেড়ে নেওয়া যায়নি। শেষে বোধোদয় হওয়ায় বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়নি যদিও। তবে পদোন্নতিও দেওয়া হয়নি। পদে পদে হয়রানি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ তখনো ক্ষমতায় বসেনি। ২০০৮ সালে সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তখনো ক্ষমতায়। ওই বছরের ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা দিবসে কারা কর্র্তৃপক্ষ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একটি কর্মসূচি উদ্বোধনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে। প্রধান অতিথি থাকার কথা ছিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুল করিমের, পরে তিনি মুখ্য সচিবও হয়েছিলেন। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে আবদুল করিম সেই কর্মসূচিতে যোগ দিতে পারেননি। ঠেলে পাঠান তার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শেখ আবদুর রশীদকে। ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ সূত্রে তিনি সেখানে হাজির হন। নির্ধারিত অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর উচ্চপদস্থ কারা কর্তাদের অনুরোধে কারাগারেই চলা বন্দিদের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। ওই অনুষ্ঠানে কারাবন্দিরা গান ও কৌতুক পরিবেশন করেন।

এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। এর ২০ দিনের মাথায় শেখ আবদুর রশীদকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয় জেলহত্যা দিবসে কারাগারের অনুষ্ঠানে অতিথি হওয়ায়। একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কিন্তু পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মত ছিল ওই তদন্তে ‘বেনিফিট অব ডাউট’-এর নীতি অনুসরণ করা হয়নি। ফলে ন্যায়বিচারের স্বার্থে ড. সাদ’ত হুসাইনের নেতৃত্বাধীন কমিশন পুনঃতদন্তের পরামর্শ দেয়। পরের বার তদন্ত করেন পরিকল্পনা কমিশনের তৎকালীন সদস্য ও পরে সাংবিধানিক পদে যাওয়া কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল মাসুদ আহমেদ। এ তদন্তে শেখ আবদুর রশীদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি বলে তিনি মত দেন। এই প্রতিবেদন ২০১২ সালের ২২ নভেম্বরের। এরপর চার বছর বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়। আবদুর রশীদকে জানানো হয়নি কেন তার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে না। চার বছর পর ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তাকে দায়মুক্তি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তত দিনে তিনি অবসরের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছেন।

আবদুল আউয়াল মজুমদার গত সরকারের আস্থাভাজন সচিব ছিলেন। তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের রেক্টর (সচিব) ছিলেন। গতকাল তিনি বলেন, ‘শেখ আবদুর রশীদকে তিনটি বাংলা বর্ণ “প” দিয়ে চিহ্নিত করা যায়। তিনি পরিণত, পরিমিত ও পরিশীলিত। তিনি দুর্দান্ত মেধাবী কর্মকর্তা। সব সময় ফার্স্ট হতেন। তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। সেখানেও রশীদ ফার্স্ট। বিসিএসেও ফার্স্ট। স্কুল-কলেজ কোথাও তিনি সেকেন্ড হননি। চাকরিতে তার প্রতি জুলুম করা হয়েছে। অবিচারের ফল কখনোই শুভ হয় না। কাউকে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করতে হয় না। আমরা ১৯৮২ (নিয়মিত)-এর ব্যাচ। এই ব্যাচ থেকে একজনকেও যদি সচিব করা হয়, সেটা পাওয়ার কথা ছিল শেখ আবদুর রশীদের। বর্তমান সরকারের চৌকস সিদ্ধান্তগুলোর একটি হলো রশীদকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব করা। এটি ইতিহাসে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ থাকবে।’

শেখ আবদুর রশীদ প্রশাসনের ব্যাচভিত্তিক রাজনীতির শিকার বলে মনে করেন জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা। তাদের মতে, ওই সময়ের কিছু ক্ষমতাধর আমলার বিদ্বেষের কারণে ২০০৯ সালে সচিব পদ থেকে বঞ্চিত করা হয় তাকে। মেধার জোরেই তিনি প্রশাসনের পদ সোপানের শীর্ষে উঠতে পারতেন। তিনি মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়ার পর অবলীলায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব হতেন। চাকরি জীবনের শেষ সাড়ে সাত বছর তাকে ওএসডি করে রাখা হয়। ওই ব্যাচের একজন কর্মকর্তা যিনি পরে জনপ্রশাসন ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হন, তিনি শত্রুতা করে আবদুর রশীদকে বঞ্চিত করেছেন। তার সঙ্গে আরও কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে।

শেখ আবদুর রশীদ কার আক্রোশের শিকার হয়েছিলেন জানতে চাইলে বর্তমান সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক জানান, ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মুয়ীদ চৌধুরীর পিএস ছিলেন শেখ আবদুর রশীদের স্ত্রী জিশান আরা আরাফুন্নেসা। তিনিও ১৯৮২ (সাধারণ) ব্যাচের কর্মকর্তা। সম্মিলিত মেধা তালিকায় তার অবস্থান ছিল ৮০তম। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তা, যারা ওই সময় ডিসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন তাদের প্রত্যাহার করে। তাদের মধ্যে আবুল কালাম আজাদ এবং কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীও ছিলেন। এই প্রত্যাহার ধরেই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। ক্ষমতার পালাবদলে কিছু কর্মকর্তা এটাকে প্রতিশোধ হিসেবে নিয়েছেন। বছরের পর বছর তদন্ত প্রতিবেদন ফেলে রেখে শুধু শেখ আবদুর রশীদকেই নয়, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরকারকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

শেখ আবদুর রশীদ পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক হন।

তিনি মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এ ছাড়া নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরের ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল স্টাডিজ থেকে পাবলিক পলিসি অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ে এমএ ডিগ্রি এবং ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসন বিষয়ে পিএইচডি অর্জন করেন।

১৯৮২ (নিয়মিত) ব্যাচের একজন কর্মকর্তা বলেন, ১৯৮২ ব্যাচ হচ্ছে সবচেয়ে মেধাবী ব্যাচ। এই ব্যাচে একটু লাগালাগি তো থাকতেই পারে। মেধাবীরা একসঙ্গে থাকলে একটু ঝুটঝামেলা হতেই পারে। এই ব্যাচে ছিলেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন, ব্যাংকিং ডিভিশনের সাবেক সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী ও আসলাম আলম, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের বর্তমান সচিব নাসিমুল গনি, এনবিআরের সাবেক সদস্য শাহাবুদ্দীন নাগরী, সাবেক অর্থ সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন ও মাহবুব আহমদ, পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ, জনপ্রশাসনের সাবেক সচিব মোজাম্মেল হক খান, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, সাবেক আইজি ও সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, রেকর্ড সময় ওএসডি থাকা ইবাদত আলী, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাবেক সচিব উজ্জ্বল বিকাশ দত্ত, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস প্রমুখ।

পরবর্তী দুই বছরের জন্য ২৫তম মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন শেখ আবদুর রশীদ। তিনি স্থলাভিষিক্ত হবেন বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনের। বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিবও প্রশাসনের প্রায় সব পর্যায়েই গ্রহণযোগ্য একজন কর্মকর্তা। এ কারণেই সব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করলেও তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করেননি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

বর্তমানে দেশের বাইরে থাকায় শেখ আবদুর রশীদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

প্রাথমিকে ২০ হাজার শিক্ষকের পদ সৃষ্টি হচ্ছে - dainik shiksha প্রাথমিকে ২০ হাজার শিক্ষকের পদ সৃষ্টি হচ্ছে স্কুল শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করা উচিত - dainik shiksha স্কুল শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করা উচিত ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.021248817443848