সব বাধা পেরিয়ে ঢাবির এমফিল প্রোগ্রামে ট্রান্সজেন্ডার সুধা - দৈনিকশিক্ষা

সব বাধা পেরিয়ে ঢাবির এমফিল প্রোগ্রামে ট্রান্সজেন্ডার সুধা

ঢাবি প্রতিনিধি |

জীবন পথের বাঁকে বাঁকে তাচ্ছিল্য, ভ্রু কুঁচকানো, অপমান, লাঞ্ছনা সব সময়ই ছিল যেন তার নিত্য সঙ্গী। সব দুঃখ-দুর্দশাকে কাঁধে নিয়ে শুধু সামনের দিকে এগোতে চেয়েছেন, জীবনকে সব সময়ই আপন তুলিতে রাঙাতে চেয়েছেন সঞ্জীবনী সুধা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকে এবার প্রথম ট্রান্সজেন্ডার নারী হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করতে যাচ্ছেন তিনি। আসছে জুলাই মাস থেকে এমফিলের ক্লাসে বসার কথা রয়েছে সুধার।

দেশের প্রেক্ষাপটে হয়তো সঞ্জীবনী সুধা একটি উদাহরণ, তবে সেই উদাহরণ হতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। শিক্ষা জীবনের প্রথম ক্লাসেই উত্ত্যক্তের স্বীকার হয়েছিলেন, বসতেও দেয়া হয়েছিল পৃথক বেঞ্চে। বুক ভরা আশা নিয়ে সেই স্কুলে গিয়েও পাননি শিক্ষকের সহযোগিতা। পেয়েছিলেন সবার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর টিটকারি। কিন্তু সঞ্জীবনীর মা বলতেন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যই তোমার শক্তি হবে। একদিন মানুষের মতো মানুষ হবে, স্কুলের চৌকাঠ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় যাবে।

বুক ভরা আশা আর চোখ ভরা স্বপ্ন, সব তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন সঞ্জীবনী সুধা। সনদে সজীব হয়ে থাকা সঞ্জীবনী সুধার ছোট থেকেই নাচের প্রতি আগ্রহ ছিল। নাচের শিক্ষক একদিন কথা প্রসঙ্গে ‘সঞ্জীবনী সুধা’ শব্দটি টেনে বলেন, এটা এমন এক মহৌষধ যা সব রোগ সারাতে পারে। 

সঞ্জীবনী সুধা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ছোট থেকে সমাজে কাছ থেকে এত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের স্বীকার হয়েছি, নিজেকে একটা বিষ মনে হতো। শব্দটি শোনার পর আমার মনে হয়েছিল ‘সঞ্জীবনী সুধা’ শব্দটি আমার সঙ্গে যায়। সেই তখন থেকেই সজীব থেকে সঞ্জীবনী সুধা হয়ে উঠি। তবে আমার সব সার্টিফিকেটে নাম সজীব লেখা।

জীবনের একটি বড় সময় টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে বেড়ে ওঠা সঞ্জীবনীর সুধার পরিবারে আছেন বাবা, মা ও ছোট এক বোন। ছোটবেলা থেকেই সমাজের লোকজনের চরম বিরূপ আচরণের শিকার সুধা, সঙ্গে পরিবারও। অনেকবার বাড়ি থেকে পালিয়েছেন, অধিকাংশ সময়ই বাবা-মা খুঁজে নিয়ে এসেছেন কখনো বা ক্লান্ত শরীরে নিজে নিজেই বাড়ি ফিরেছেন।

তিনি বলেন, আশেপাশের এতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, হাসি-ঠাট্টার স্বীকার হয়ে যখন নিতে পারতাম না সহ্যের বাঁধ ভেঙে যেতো তখন ঈশ্বরকে বলতাম আমার মৃত্যু দাও। এ জীবনে ভিক্ষা করেছি, চেয়ে খাবার খেয়েছি, যখন এসব করতাম তখন ভীষণ কষ্ট লাগত। সব সময়ই মনে হতো আমি এর চেয়ে ভালো কিছু ডিজার্ভ করি। ভেঙে পড়েছি অনেকবার, তবু বারবার উঠে দাঁড়িয়েছি। স্বপ্ন পূরণের দিকে ছুটেছি।

জীবন যুদ্ধের প্রতিযোগিতায় মা ছিল সুধার কাছে সব সঞ্জীবনী শক্তির উৎস। যতবার ভেঙে পড়েছেন সাহস জুগিয়েছেন সুধার মা। স্থানীয় স্কুল-কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষে জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন। সব কয়েকটি সুযোগ পেলেও ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে। সেখানেও সহ্য করতে হয়েছে বৈষম্য। তবু সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সহপাঠীরা ছিলো তাঁর জীবনে আর্শীবাদ। দীর্ঘ সময় ধরে হলে থেকেছেন চবির ছেলেদের আলাওল হলে।

তিনি বলেন, একটা দীর্ঘ সময় ধরে আলাওল হলে থেকেছি। আমাকে একটি কক্ষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলো। তবে বলা হয়েছিল আমি যেন ছেলেদের পোশাক পরি, ছেলেদের মতো চলা-ফেরা করি। তেমনই চলেছি, তবে হলে অনেক সময়ই টিটকারির শিকার হয়েছি। তবে সেক্ষেত্রে শিক্ষক-সহপাঠীরা ছিলেন আমার জন্য আর্শীবাদ। তারা সাহস জুগিয়েছেন, পাশে ছিলেন বলে সুন্দরভাবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করতে পেরেছি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে পাস করেছেন সুধা। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে একটি বেসরকারি ব্যাংকে ‘কমিউনিকেশন অ্যান্ড সিএসআর অফিসার’ হিসেবে যোগ দেন সুধা।

এবার ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে সঞ্জীবনী সুধা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধীন এমফিল করতে যাচ্ছেন। তার এমফিলের বিষয় ‘রিফ্রেমিং জেন্ডার ইন পলিটিকস অব বাংলাদেশ’। জুলাই থেকে ক্লাস শুরুর কথা রয়েছে তার। 

সঞ্জীবনী সুধা বলেন, সেই ছোট থেকেই এই সমাজের লোকজন আমাকে পৃথক করে ফেলেছে। প্রতি পদে পদে তারা নানাভাবে জানান দিতো যে আমি আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো না, আমার কোন স্বপ্ন থাকতে পারে না। সাধারণ মানুষ মতো সম্মান নিয়ে এ সমাজে বাঁচার কোন অধিকার নেই। মানুষের আচরণে নিজেকে মানুষ বলে মনে হতো না। আমি সাধারণ মানুষ হয়ে বাঁচতে চেয়েছি, নানা চড়াই-উতরাই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে এতদূর এসেছি। অনেক আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল উচ্চতর ডিগ্রি নেবো। আমাকে পড়ালেখা দিয়ে এই অবহেলা-অবজ্ঞার জবাব দিতে হবে। পড়াশোনার সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত আমাকে যেতে হবে। এর মাধ্যমে সমাজও একটি বার্তা পাবে। 

তিনি বলেন, ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির লোকজন আমাকে বিভিন্ন সময় তাদের কমিউনিটিতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আমার মা নিয়ে যেতে দেননি। যখন তারা আসত, আমার মা আমাকে লুকিয়ে রাখত। যারা লিঙ্গ বৈষম্য কারণ দেখিয়ে ট্রান্সজেন্ডারদের দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করেন এটি ঠিক না। তাঁদের প্রতি যত্নবান ও সচেতন হলে তাঁরাও এ সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পদ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে।

সঞ্জীবনী সুধা বলেন, জীবন সংগ্রামেরই। সংগ্রামহীন জীবন হয় না, তবে এই সংগ্রামী জীবনে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, হতাশা-ব্যর্থতা থাকবেই সকল কিছুকে পাস কাটিয়ে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সব সন্তানের প্রতি একটা অনুরোধ থাকবে পরিবারের সম্পদ হোন, এমন সম্পদ হয়ে নিজেকে গড়ে তুলুন যেন বাবা-মা আপনাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে।

কথা শেষের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, হাজারো সঞ্জীবনী আছে যারা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে আছে। তবে বাবা-মা, পরিবার পাশে থাকলে সঞ্জীবনীরা স্বপ্ন দেখতে পারে, নিজেকে নিজের মতো গড়ে তুলতে পারে। আর চারটা সাধারণ মানুষের সঞ্জীবনীদের নিজেদের গড়ে তোলার সেই সমর্থ্য রয়েছে। শুধু পরিবার-সমাজের লোকজনের শুধু সদিচ্ছা প্রয়োজন। আমি যেই সময়টা পার করে এসেছি, বর্তমানে সমাজ-রাষ্ট্র মানুষের মন-মানসিকতা অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। আমার এটিই প্রত্যাশা এমন একদিন আসবে যেদিন সকলেই ট্রান্সজেন্ডারদের সবাই আপন করে নেবে, কেউ তাঁদের পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের বোঝা মনে করবে না।

যেসব চাকরির পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha যেসব চাকরির পরীক্ষা স্থগিত কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে সরকার - dainik shiksha কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে সরকার উত্তরায় গুলিতে ২ শিক্ষার্থী নিহত - dainik shiksha উত্তরায় গুলিতে ২ শিক্ষার্থী নিহত ছাত্রলীগ আক্রমণ করেনি, গণমাধ্যমে ভুল শিরোনাম হয়েছে - dainik shiksha ছাত্রলীগ আক্রমণ করেনি, গণমাধ্যমে ভুল শিরোনাম হয়েছে সহিংসতার দায় নেবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - dainik shiksha সহিংসতার দায় নেবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জবিতে আজীবনের জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আশ্বাস প্রশাসনের - dainik shiksha জবিতে আজীবনের জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আশ্বাস প্রশাসনের মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানালেন পলক - dainik shiksha মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানালেন পলক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0060110092163086