সরকারের শীর্ষ পর্যায় চায় সরকারি বা বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ হোক। বিশেষ করে সরকারি চাকরি সহজ করার জন্য গত এক যুগে নানা নির্দেশনা এসেছে সেখান থেকে। কিন্তু এলে কী হবে! ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি’। আর যাদের হাতে চাকরি সহজ করার দায়িত্ব তারা শোনে না বেকারের আর্তনাদ। আর শোনে না বলেই চাকরি নিয়ে মানুষের এত হয়রানি, দুর্ভোগ আর আর্তনাদের কষ্টগাথা। রোববার (১২ মার্চ) দেশ রুপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আশরাফুল হক ও ইমদাদ হোসাইন।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায় সরকারি হোক বা বেসরকারি, চাকরির বাজারে ঘোর মন্দা না হলেও মন্দা চলছে। চাকরির বাজার যত সংকুচিত হচ্ছে, ততই কদর বাড়ছে বাঁকা পথের খেলোয়াড়দের। নিয়োগের খেলা বুঝে নিয়ে তারা নিজেদের পকেট ভরছে দুই হাতে। অথচ কয়েক বছর আগেও তারা শুধু সাধারণ নয়, অতি সাধারণ ছিল। কেউ ছিল ছোট ব্যবসায়ী, কেউবা রোজগারহীন। নিয়োগ দুর্নীতির বদৌলতে তারাই এখন কোটি টাকার মালিক। এ ছা-পোষা, সাধারণ মানুষগুলো মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে কেউ দুর্নীতি করছেন। কেউ আবার দুর্নীতিবাজের হয়ে মধ্যস্থতাকারীর কাজ করে কোটি টাকা কামাচ্ছেন। দিন দিন স্ফীত হচ্ছে তাদের ব্যাংক স্থিতি আর অন্যান্য সম্পত্তি। আর যারা দুর্নীতিবাজ, তাদের বৃদ্ধি কোনো হিসাবেই কুলায় না। তারা দেশের ব্যাংকে রেখে স্বস্তিও পায় না। পাচার করে দেয় বিদেশে, তাদের সেকেন্ড হোমে। ২০০৯ সালে দায়িত্ব নিয়েই সরকারপ্রধান চাকরির বাজারের দুর্দশা ঘোচানোর নির্দেশনা দেন সচিব সভায়। সভায় বলা হয়, সংবিধানে একাধিক পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) গঠনের সুযোগ আছে। আলাদা পিএসসি করে শূন্য পদ পূরণে গতি আনার নির্দেশনা পেলেন সচিবরা। কমিটির পর উপকমিটি হয় আর সময়ক্ষেপণ হয়। অনেক ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে একাধিক পিএসসি করার রাস্তা কৌশলে আটকে দেওয়া হয়।
ফের নির্দেশনা আসায় ২০১৩ সালে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে প্রধান করে গঠন করা হয় সচিব কমিটি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে শূন্য পদের তথ্য এনে জানার চেষ্টা করা হয় এত শূন্য পদের কারণ কী। এ কমিটি পদ সৃজনে দীর্ঘ সময় ব্যয় হওয়ার কারণ খুঁজে বের করে। একটি নতুন পদ সৃজন থেকে চূড়ান্ত নিয়োগ পর্যন্ত পাঁচ বছর সময় লাগে। এ তথ্য খুঁজে বের করা হলেও তা বেকার সমস্যা কমায়নি মোটেও। ওই সময়ের মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বিশ্বব্যাংকে যোগদানের সময় ঘনিয়ে আসায় তাড়াহুড়ো করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। যা কোনো কার্যকর পরিবর্তন আনতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
আইন ও বিভিন্ন বিধি অনুযায়ী পিএসসি শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বিভিন্ন পদে প্রার্থী বাছাই করে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন শূন্য পদ পূরণ করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা অধিদপ্তর। কিন্তু এসব নিয়োগ নিয়ে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেরা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় না গিয়ে তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব দেয়। এ কাজে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগ বা ইনস্টিটিউট সুনাম কুড়ালে আরও কয়েকটি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এ কাজে প্রতিযোগিতায় নামে। একপর্যায়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজ পড়াশোনা করানো, চাকরির প্রার্থী বাছাই করা তাদের কাজ নয়। এ চিন্তা থেকেই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শূন্য পদে জনবল নিয়োগে আউটসোর্সিং নিষিদ্ধ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপরই ২০১৯ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব আসে পিএসসির কাঁধে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব দেওয়ার।
সরকারের ১৩ গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেডের (তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির) বিভিন্ন শূন্য পদে জনবল বাছাই করে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশের কাজ করতে হলে পিএসসিতে ১৯২টি পদ সৃষ্টি করতে হবে। বিভিন্ন সংস্থার আলাদা আলাদা নিয়োগ বিধি বিলুপ্ত করে অভিন্ন বা বেষ্টনী নিয়োগ বিধি করতে হবে। এ ছাড়া তিনটি অর্ডিন্যান্স ও রেগুলেশন সংশোধন করাসহ পাঁচ দফা পর্যবেক্ষণ দিয়েছে পিএসসি।
কৌশলে পিএসসি দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে। ১৩ থেকে ২০ পর্যন্ত বেতন গ্রেডের পদে সরকারি কর্মচারী নিয়োগের কর্তৃপক্ষ ও পদ্ধতি নির্ধারণসংক্রান্ত পিএসসির প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে কমিটি গঠন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এসব পদে নিয়োগের কর্তৃপক্ষ ও পদ্ধতি নির্ধারণসংক্রান্ত সুপারিশ প্রণয়নের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে আট সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করা হয় ২০২০ সালে। কমিটির দায়িত্ব ছিল ১৩ থেকে ২০ পর্যন্ত বেতন গ্রেডের পদে নিয়োগের কর্তৃপক্ষ ও পদ্ধতি নির্ধারণ করা। কমিটির মেয়াদ ছিল তিন মাস। নির্ধারিত সময়তো বটেই, তিন বছরেও কমিটি কোনো সুপারিশ করতে পারেনি। এ কমিটি একই কাজ করার জন্য আরও তিন মাস সময় নিয়েছে।
পিএসসির আদলে নিয়োগ কর্তৃপক্ষ করা হলে চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করা সম্ভব। কিন্তু সরকারের এ উদ্যোগটিও আটকে আছে। সরকারের একের পর এক উদ্যোগ আটকে দিলেও চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া, চাকরি দিতে ব্যর্থ হয়ে টাকা ফেরত না দিয়ে পরিবারগুলোকে পথে বসিয়ে দেওয়া বা বেকারের আর্তনাদ বন্ধ করতে পারলেন না কর্তারা। চাকরি নিয়ে মানুষের দুর্ভোগ আগের মতোই রয়েছে। যত দিন যাচ্ছে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার টাকার অঙ্কও বাড়ছে। মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমেই নিয়োগ দুর্নীতির টাকা পৌঁছে যাচ্ছে প্রভাবশালীদের কাছে।
প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, চাকরি নিয়ে প্রতারণা কোনো পর্যায়ে গেলে মন্ত্রণালয় থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বলা হয় প্রতারকের খপ্পরে পড়বেন না।
গত বছর ২২ মার্চ ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বলা হয়, ভূমি মন্ত্রণালয় এবং এর আওতাভুক্ত দপ্তর ও সংস্থায় চাকরি দেওয়ার নাম করে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। শুধু ভূমি নয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়সহ আরও কিছু মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
কারোনা মহামারীর সময় বেকার সমস্যা চরমে পৌঁছেছে। মহামারী ও সেই ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের এ পর্যায়ে এসেও চাকরির নামে প্রতারণা বেড়েছে। মাসের পর মাস বেকার থাকার ফলে অনেকে ভুয়া চাকরির ফাঁদে পা দিচ্ছেন। প্রার্থীকে জাল নিয়োগ প্রস্তাব বা নিয়োগপত্র দেওয়া হচ্ছে। স্মার্টফোনে হরদম চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। এগুলো থেকে কীভাবে বেকাররা নিজেদের রক্ষা করবেন জানতে চাইলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, স্মার্টফোনে আসা অযাচিত লিংক ক্লিক করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এ লিংকগুলো যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, তাতে সাড়া দেওয়া যাবে না। অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করার আগে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে। চাকরির জন্য কাউকে টাকা দেওয়া যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরিপ্রার্থী সোহেল হায়দার জানিয়েছেন, চাকরি দেওয়ার নাম করে শুধু যে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়, তা নয়। অনেক সময় ছোট ছোট পরিমাণ টাকাও হাতিয়ে নেওয়া হয়। রেজিস্ট্রেশন ফি বা স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফি এমন নানা অজুহাতে এসব টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। একপর্যায়ে প্রতারক সরে পড়ে। চাকরি প্রার্থীরা যখন বুঝতে পারে তারা প্রতারিত হয়েছে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়।
অবসরে যাওয়া একজন শ্রম সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ ধরনের প্রতারণা বন্ধ করতে হলে চাকরি বাজার সহজ করতে হবে। সাধারণ মানুষ কীভাবে চাকরি পাবে সেটা দৃশ্যমান করতে হবে। সরকারের কর্মকর্তাদের চাকরি দিয়ে ঘুষ আদায় বন্ধ করতে হবে। চাকরি দেওয়ার পদ্ধতি সহজ ও স্বচ্ছ না করলে প্রতারণা বন্ধ করা যাবে না।
তিনি মনে করেন, চাকরির বাজারে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। প্রতি বছর চার থেকে পাঁচ লাখ তরুণ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছেন। তারা সবাই চাকরির বাজারে যুক্ত হচ্ছেন। অথচ তাদের উপযোগী চাকরি নেই। এসব শিক্ষিত চাকরি প্রার্থী আরামদায়ক কাজ করতে চান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে হারে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর তৈরি করছে, সেই পরিমাণ আরামদায়ক চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে না বা হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই সরকার যতই উদ্যোগ নিক না কেন, চাকরি সহজ করা সহজ নয়। সরকার প্রতি বছর গড়ে ৫০ হাজারের বেশি শূন্য পদ পূরণ করতে পারে না। পদ শূন্য থাকার পরও পারে না। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে চাকরি খাতে ব্যাপক সংস্কার দরকার। যে সংস্কারের উদ্যোগ আছে, বাস্তবায়ন নেই।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশের সরকারি ব্যয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় অনেক কম। ভারতের এ ব্যয় জিডিপির তুলনায় ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ আমাদের দেশে সরকারি ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। সরকারি সেবাগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে গেলে মানবসম্পদে আরও ব্যয় বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে এসব জায়গায় জবাবদিহি, দক্ষতা, মেধার ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ, দক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতির বিষয়গুলো নিশ্চিত না করলে এ ধরনের প্রশাসন দিয়ে লাভ হবে না।’