দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক : দেশের সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। মৌলিক বিষয়ে চাহিদার প্রায় অর্ধেক পদই দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। ৩৭টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ৭২৪৭ পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৪১৫০ জন। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোয় অবস্থা আরো করুন। বেশিরভাগ শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় এমবিবিএস কোর্সের শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শিক্ষা উপকরণের সংকটও প্রকট। বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আবুল খায়ের।
প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যারা পাশ করছেন, তারা আধুনিক বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সব বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না। এছাড়া মানসম্পন্ন শিক্ষক না থাকায় প্রকৃত শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। ডাক্তার তৈরির মূল প্রতিষ্ঠানগুলোর এই করুণ অবস্থা উদ্বেগজনক। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থায়। কি ধরনের ডাক্তার তৈরি হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সরকারি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, সরকারি মেডিক্যাল কলেজে দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষক সংকট চলছে। বারবার প্রস্তাব দেয়া হয়, কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পাত্তা দেন না। এই অবস্থা চলতে থাকলে মানসম্পন্ন চিকিৎসক তৈরি সম্ভব নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসা-শিক্ষার মান উন্নয়নের যখন যা প্রয়োজন তাই দিচ্ছেন। ৮টি মেডিক্যাল কলেজ থেকে বাড়িয়ে ৩৭টি করা হয়েছে। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা এখন ৭২টি। এসব হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর শাসন আমলে। কিন্তু মেডিক্যাল শিক্ষা মান উন্নয়নে পদে পদে বাধা মন্ত্রণালয়। চাহিদা দেয়া হলে তা উপেক্ষা করা হয়, এমনকি সিনিয়র ডাক্তাররা অপমানিত হন। এ কারণে এসব বিষয় নিয়ে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ও অধ্যক্ষরা মন্ত্রণালয়ে যেতে চান না। অতি সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা ঢাকার বাইরে একটি মেডিক্যাল কলেজের একজন অধ্যাপকের পদায়নের জন্য একজন যুগ্ম সচিবের কাছে প্রস্তাব দেন। উত্তরে ওই কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার বাইরে অধ্যাপক দেয়ার দরকার কি? আসলে এই বিষয়টি ওই কর্মকর্তার নয়। এই বিষয় সম্পর্কে তার কোন অভিজ্ঞতাও নেই। এ কারণে তার জায়গা থেকে তিনি ঠিকই বলেছেন বলে অধিদপ্তরের ওই কর্মকর্তা জানান। মন্ত্রণায়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, যা আছে তাই দিয়ে চালান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাথে মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে রয়েছে বড় ঘাটতি। এটা অবসান না হলে মেডিক্যাল শিক্ষার আন্তর্জাতিক মান তলানিতে চলে যাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অভিমত ব্যক্ত করেন। তারা বলেন, বর্তমানে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে সৃষ্ট শিক্ষক পদের তিন গুণ শিক্ষক প্রয়োজন। তাহলে ছাত্র-ছাত্রীরা সুশিক্ষা পাবেন। কিন্তু বর্তমানে যে পদ সৃষ্টি করা আছে, তার অর্ধেক শূন্য। এটা চলতে থাকলে মেডিক্যাল কলেজগুলো ছাত্ররা সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, পরবর্তীতে রোগীরাও সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবেন। এ ব্যাপারে তারা অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামান্ত লাল সেন অত্যন্ত সৎ ও কর্মঠ। তিনি বলেন, শিক্ষক সংকট সমাধানে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। এ ব্যাপারে কোন আপোষ করা হবে না।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে অনুমোদিত শিক্ষক পদ আছে ৪৬৭ জন। কিন্তু কর্মরত আছে ৩২৬ জন। ১২৪ জন শিক্ষক পদ শূন্য। এই মেডিক্যাল কলেজের একজন শিক্ষক বলেন, এই অবস্থায় মেডিক্যাল শিক্ষার মান কেমন হবে তা আর বলার উপেক্ষা রাখে না। এই বিষয়টি নিয়ে যেন মন্ত্রণালয় চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে আছে। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে অর্ধেক শিক্ষক পদ শূন্য। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষক পদ আছে ৬০৪ জন। কিন্তু কর্মরত আছেন ৩৯৯ জন। ২০৫টি শিক্ষক পদ শূন্য। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে অর্ধেক শিক্ষক পদ শূন্য রয়েছে। ৫৫ জন অধ্যাপকের মধ্যে আছেন মাত্র ২০ জন। রংপুর মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষক পদ আছে ৩০৯টি। কর্মরত আছেন ১৮৪ জন শিক্ষক। ১২৫টি শিক্ষক পদ শূন্য। বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে ২০৫ জন শিক্ষক পদ আছে। এর মধ্যে কর্মরত ৯৩ জন শিক্ষক। ১১২ পদ শূন্য। দেশের সবগুলো সরকারি মেডিক্যাল কলেজেই শিক্ষক সংকটের একই অবস্থা। অন্যদিকে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে কি পড়াশুনা করানো হয়, তা আর বলার অপেক্ষা নেই। বেশিরভাগ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার পরিবেশ নেই।
বিএমএডিসির একজন সদস্য জানান, মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষা মান বাড়াতে বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোন সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি মন্ত্রণালয়। অন্ধজন যেমন লিখতে পারে না, তেমনিই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণীর কর্মকর্তার অবস্থা একই ধরনের। এ কারণে যাদের অর্থ আছে তারা বিদেশে এমবিবিএস পড়ালেখার দিকে ঝুঁকছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সন্তানরাও বিদেশে পড়ালেখা ও চিকিৎসা নিতে যান। বিএমডিসিরি ওই সদস্য আরো বলেন, সম্প্রতি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পরিদর্শনে গিয়ে করুন অবস্থা দেখেছি। তাদের সুপারিশে ৭টা বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মানুষ মারার জন্য যেন ডাক্তার তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে এমন পরিবেশ। প্রধানমন্ত্রী দুই হাত দিলেও বাস্তবায়ন যাদের হাতে তারা তেমন ভূমিকা পালন করছেন না। তারা উল্টো পথে হাঁটছেন। আধুনিক যুগে দেশের মেডিক্যাল শিক্ষায় এই দূরবস্থার কারণে মানুষ বিদেশমুখী হচ্ছে।
সরকারি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষরা বলেন, মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকটের কারণে কঠিন অবস্থা বিরাজ করছে। এটা চলতে থাকলে মেডিক্যাল শিক্ষায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তলানিতে দ্রুত যাবে। এই অবস্থার কারণে ভুল চিকিৎসায় মানুষ মৃত্যুর হারও বাড়বে। পৃথিবীর সব দেশে শিক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিচালিত হয় ডাক্তার দিয়ে। কিন্তু আমাদের দেশে বিশেষায়িত এই মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন আমলারা। বিশেষায়িত কোন জরুরি বিষয় আমলাকে বোঝাতেই তো অনেক সময় চলে যায়। তারা দ্রুত সমাধান দেবে কিভাবে? এই অবস্থা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। নইলে স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মেডিক্যাল কলেজগুলোয় শুধু যে শিক্ষক সংকট রয়েছে তা নয়, অবকাঠামো থেকে শুরু করে পরীক্ষাগার, হোস্টেলসহ সবখানেই সংকট রয়েছে। এছাড়া লোকবলের ঘাটতি রয়েছে সব শাখায়। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এসব মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক পদোন্নতি জটিলতা দ্রুত নিরসন করা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষার সহজ সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি প্রয়োজনে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হবে। মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষক ও সরঞ্জামাদির সংকট থাকায় এমবিবিএস কোর্সে সম্পূর্ণ শিক্ষা তারা পাচ্ছেন না। নানা ঘাটতি নিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।