আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস প্রতিবছর ৮ সেপ্টেম্বর পালিত হয়। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেসকো প্রতিষ্ঠিত দিবসটি বিশ্বব্যাপী শিক্ষার গুরুত্ব ও সাক্ষরতার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উদযাপন করা হয়। এই দিনটি কেবলমাত্র পড়া ও লেখা শেখার চাহিদা নয়, বরং মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক উন্নতির জন্য শিক্ষার অপরিহার্য ভূমিকা তুলে ধরে।
সাক্ষরতা শুধু একটি মৌলিক দক্ষতা নয়; এটি একটি জাতির উন্নয়নের সূচক। সাক্ষরতা বৃদ্ধি পেলে জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিক্ষিত মানুষরা সাধারণত সচেতন নাগরিক হন, যারা সমাজের উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম। সাক্ষরতা একটি মৌলিক মানবাধিকার যা একজন ব্যক্তির জীবনকে পরিবর্তিত করতে সক্ষম। এটি কেবলমাত্র পাঠ এবং লেখার ক্ষমতা নয়, বরং এটি তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, এবং চিন্তাভাবনার ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত। সাক্ষরতা মানুষের জীবনে অনেক দিক থেকে প্রভাব ফেলতে পারে।
সাক্ষরতা মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করে ও তাদের অর্থনৈতিক সাফল্যের সম্ভাবনাকে উন্নত করে। এটি স্বাস্থ্যসেবা, আইনগত অধিকার ও সামাজিক সেবার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। শিক্ষার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং সামাজিক সমন্বয় সাধন সম্ভব হয়।
বর্তমানে বিশ্বে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে এখনো কিছু অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ মৌলিক সাক্ষরতা থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও কিছু উন্নয়নশীল দেশে সাক্ষরতার অভাব একটি গুরুতর সমস্যা। এসব অঞ্চলে সাক্ষরতার অভাব বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করে। যেমন-অনেক দেশ শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ফান্ডিং দিতে পারে না, ফলে শিক্ষাব্যবস্থা দুর্বল হয়। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা। অনেক স্থানে সামাজিক রীতিনীতি ও সংস্কৃতি নারীদের শিক্ষা গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে।
সাক্ষরতা অভাবের কারণে অনেক শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকে, যা তাদের ভবিষ্যতের সুযোগ সীমিত করে। সাক্ষরতার অভাবে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্য এবং পরিষেবার প্রাপ্তি কমে যায়। অশিক্ষা মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগকে সীমিত করে এবং দরিদ্র্যতা বৃদ্ধি করে।
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালন করার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয় এবং সাক্ষরতার প্রসারিতকরণে নতুন দিশা প্রদর্শন করা হয়। এই দিনটি উপলক্ষে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলগুলোতে বিশেষ অনুষ্ঠান, কর্মশালা, সেমিনার, এবং ক্যাম্পেইন পরিচালিত হয়। বিভিন্ন স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ শিক্ষা কর্মসূচি আয়োজন করে, যেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়।
মিডিয়া ও প্রকাশনা মাধ্যমে সাক্ষরতার গুরুত্ব বিষয়ে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়। সরকার ও এনজিও প্রতিষ্ঠান সাক্ষরতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রকল্প এবং নীতিমালা গ্রহণ করে।
প্রতিবছর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের একটি নির্দিষ্ট থিম থাকে যা বিশ্বব্যাপী সাক্ষরতার ক্ষেত্রে চলমান সমস্যাগুলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। থিমের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় নতুন কৌশল ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত সরকার ‘সর্বজনীন শিক্ষা’ প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যেখানে প্রত্যেক শিশুর শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া, আফ্রিকার কিছু দেশ ‘বেসিক এডুকেশন’ প্রকল্পের মাধ্যমে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি করতে কাজ করছে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অনুযায়ী, ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সকলের জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা একটি মৌলিক লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার, এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একসঙ্গে কাজ করছে।
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট দিনে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি আমাদের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতি এবং উদ্যোগের প্রতিফলন। এই দিবসটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে শিক্ষা ও সাক্ষরতার প্রসারিতকরণ সকলের জন্য একটি মৌলিক অধিকার এবং এটি একটি উন্নত সমাজ গড়ার জন্য অপরিহার্য। আসুন, আমরা সবাই মিলিতভাবে সাক্ষরতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করি এবং একটি শিক্ষিত ও সমৃদ্ধিশালী
লেখক: শিক্ষক, কুর্মিটোলা হাই স্কুল এন্ড কলেজ