সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ - দৈনিকশিক্ষা

সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের ৬৮ জন মেডিক্যাল অফিসার নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। এই অনিয়মের সঙ্গে বিএসএমএমইউ, সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কার্যালয়ের তিন কর্মকর্তার নাম শোনা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন নিয়োগ কমিটির প্রধান, একজন উপাচার্য কার্যালয়ের ব্যক্তিগত সহকারী ও সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের এক কর্মকর্তা। 

বিএসএমএমইউ ও সুপার স্পেশালাইজ হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বলেছেন, এই তিনজনের নেতৃত্বাধীন একটি চক্র পরীক্ষার আগেই অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন ফাঁস করেছে। এ নিয়ে পরে যাতে কোনো ধরনের আন্দোলন না হয় সেজন্য তারা নামমাত্র বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকেও প্রশ্ন দেন। তবে দলীয়দের মধ্যে উপাচার্য ও এই চক্রের ঘনিষ্ঠজনরাই শুধু এই প্রশ্ন পেয়েছেন। ফলে নিয়োগ পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) আরও চারটি গ্রুপের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছেন। দুদিন ধরে তারা বিএসএমএমইউতে নিয়োগ পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন।

এমন অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবারও স্বাচিপ সমর্থিত অন্যান্য গ্রুপের চিকিৎসকরা বিক্ষোভ করেন। তারা বিএসএমএমইউয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন ও বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরে স্মারকলিপি দিয়েছেন।

তবে এই নিয়োগ পরীক্ষায় কোনো অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে বলেন, তারা (সাক্ষাৎকারীরা) নিয়োগ কমিটির বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ তুলেছেন। এই নিয়োগ কমিটির সভাপতি বিএসএমএমইউর উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এডিশনাল সেক্রেটারি, অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সদস্য। যেহেতু তারা অভিযোগ এনেছেন, তাই ইতিমধ্যেই আমি চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছি। কমিটি সাত দিনের মধ্যে তদন্ত করে যা জানাবে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।

যারা সাক্ষাৎ করেছেন, তারা নিজেদের সরকারদলীয় চিকিৎসক হিসেবে দাবি করেছেন বলে জানান উপাচার্য। তিনি বলেন, ‘তারা নির্বাচনের আগে এ রকম একটা অরাজকতা তৈরি করতে চাইছে। তবে এই নিয়োগ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করাটা ঠিক হবে না। কারণ নিয়োগ কমিটিতে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও রয়েছেন। যারা এমনটা করছেন তাদের বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। কারণ কোনো ধরনের অনিয়ম হয়েছে বলে আমরা মনে করি না।’

গত ২০ অক্টোবর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, অর্থোপেডিকস ও ডেন্টাল বিভাগের ৬৮ জন মেডিক্যাল অফিসার নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা হয়। পরীক্ষার পরদিন রাত সাড়ে ৮টার পর লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। লিখিত পরীক্ষায় ৩৫০ চিকিৎসককে উত্তীর্ণ করা হয়। পরে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের মধ্য থেকে ৬৮ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এই নিয়োগ পরীক্ষার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি তিনবার সংশোধন করা হয়।

যেভাবে ফাঁস হলো প্রশ্ন : নিয়োগ কমিটি ও লিখিত পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকরা জানান, এই নিয়োগ কমিটির প্রধান উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমদ। তার দায়িত্ব হচ্ছে পরীক্ষা কমিটি করা। পরীক্ষা কমিটি প্রশ্ন করবে। কিন্তু তিনি কোনো পরীক্ষা কমিটি করেননি। বরং প্রশ্ন তৈরি থেকে শুরু করে প্রশ্ন মডারেশন সবকিছু এই নিয়োগ কমিটির অধীনেই হয়েছে।

প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাটা ঘটেছে মডারেশনের সময় জানান একাধিক চিকিৎসক ও মডারেটর। তারা বলেন, মডারেশন হলো একটি প্রশ্ন করার আগে প্রায় ৫০ জন শিক্ষকের থেকে প্রশ্ন নেওয়া হয়। এবার ৫৫ জন শিক্ষক প্রশ্ন দিয়েছিলেন। তাদের প্রশ্ন থেকে ১০টি করে প্রশ্ন নিয়ে ১০০ প্রশ্ন চূড়ান্ত করা হয়। এসব প্রশ্ন কয়েক ধাপে বাছাই করা হয়। এবার মডারেটরদের পরিবর্তে অভিযুক্ত চক্রের তিনজন প্রথম ধাপের ৩০০ প্রশ্ন বাছাই করেন। পরে সেই ৩০০ প্রশ্ন থেকে মডারেটরদের ১০০ প্রশ্ন বাছাই করতে বলা হয়। তার আগেই সেই তিনশ প্রশ্ন এই চক্র ফাঁস করে দেয়। পরীক্ষার পর যখন এই চক্রের লোকজন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো, তখন সবার সন্দেহ হয় ও ফাঁসের বিষয়টি সামনে চলে আসে।

পেছনে আর্থিক লেনদেন ও দলীয় নিয়োগ : মূলত অর্থের বিনিময়েই প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে সেটাকে রাজনৈতিক রঙ দিতে কিছু প্রশ্ন এই চক্রের ঘনিষ্ঠ সরকারদলীয় বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও স্বাচিপ সমর্থিত চিকিৎসকদেরও দেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে বিএসএমএমইউয়ের এক চিকিৎসক ও স্বাচিপ নেতা বলেন, প্রশ্ন গণহারে আউট হয়নি। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ৩৫০ পরীক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ৫০ জনের মতো প্রশ্ন পেয়েছেন। তাদের মধ্যে ভিসির সঙ্গে যারা চলেন এ রকম ১০ জনের মতো ছাত্রলীগের রেখেছে। বাকিগুলো অর্থের বিনিময়ে হয়েছে। বাকিরা মেধার ভিত্তিতে।

কী পরিমাণ টাকা লেনদেন হতে পারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, কিছুদিন আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ হয়। সেখানেও প্রচুর সুপারিশ আসে। তখন মন্ত্রিপর্যায় থেকে সেই নিয়োগ বন্ধের পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু তখন জোর-জবরদস্তি করে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে ৬০ লাখ টাকা লেনদেন হয়। তবে এবার ঠিক কী পরিমাণ টাকায় প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, সেটা সঠিক বলতে পারছি না। ৪০-৫০ জনের মতো প্রশ্ন পেয়েছেন। সেখান থেকে পলিটিক্যাল ১০ জন। বাকি ৪০ জনের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন হয়েছে।

বিএসএমএমইউয়ের স্বাচিপ নেতারা জানান, এবার শুধু উপাচার্য ও তার আশপাশের লোকজনের ঘনিষ্ঠজনরা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এর মধ্যে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ, বগুড়া মেডিক্যাল কলেজ, সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ ও ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা রয়েছেন।

ক্ষুব্ধ স্বাচিপের অন্যান্য গ্রুপ : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসএমএমইউ স্বাচিপের সাবেক ও বর্তমান একাধিক নেতা বলেন, বিএসএমএমইউতে স্বাচিপের বিভিন্ন গ্রুপ আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, স্বাচিপের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান ও মহাসচিব ডা. আবদুল আজিজ এবং বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদের গ্রুপ এখনো সক্রিয় ও শক্তিশালী। এই নিয়োগে উপাচার্য সমর্থিতরা বাদে অন্য গ্রুপের চিকিৎসকরা বঞ্চিত হওয়ায় তারা ক্ষেপেছেন ও দুদিন ধরে নিয়োগ বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। গতকাল তারা উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করেছেন। উপাচার্য তদন্ত কমিটি করার আশ্বাস দেন। তদন্ত কমিটি তদন্ত করবে। তার আগে পর্যন্ত এটার মৌখিক পরীক্ষা হবে না।

স্মারকলিপিতে উঠে এলো যেসব অনিয়ম : ক্ষুব্ধ চিকিৎসকরা গতকাল উপাচার্যকে স্মারকলিপি দিয়েছেন। স্মারকলিপিতে পরীক্ষা ও ফলাফলকেন্দ্রিক বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয় ১. নিয়োগ কমিটি করা হলেও সুষ্ঠু পরীক্ষার জন্য এক্সামিনেশন কমিটি করা হয়নি, নিয়োগ কমিটির সভাপতির থেকেই প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। ২. বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুয়ায়ী বিভিন্ন শিক্ষকদের থেকে প্রাপ্ত প্রশ্ন কন্ট্রোলার অফিসে জমা দেওয়ার কথা এবং তা কন্ট্রোলার অফিসের ভল্টে সিলগালা থাকার কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত সব পরীক্ষা এই অনুযায়ী হয়েছে। কিন্তু এ পরীক্ষায় শিক্ষকদের থেকে প্রাপ্ত প্রশ্ন কন্ট্রোলার অফিসে জমা না দিয়ে নিয়োগ কমিটির সভাপতি উপ-উপাচার্যের কাছে জমা হয়েছে। সেখান থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের সব নিয়োগে বাণিজ্যকারী কিছু অসাধু শিক্ষক তা অর্থের বিনিময়ে ফাঁস করেন।

স্মারকলিপিতে প্রশ্ন মডারেশনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। সেখানে বলা হয়, মডারেশনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন প্রার্থীর কাছে প্রশ্ন বিক্রি করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ উত্তীর্ণ হওয়া কিছু প্রার্থীর আগের অ্যাকাডেমিক ফলাফল যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি করে।

স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, পরীক্ষার ৩২ ঘণ্টা পর ফল প্রকাশিত হয়। অথচ রেসিডেন্সি ও নন-রেসিডেন্সি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয় পরীক্ষার ৬-৮ ঘণ্টার মধ্যে। এবার ফল প্রকাশের এই কালবিলম্ব যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি করেছে বলেও স্মারকলিপিতে বলা হয়। এমনকি ৫০০১৫ রোল নম্বরের প্রার্থী পরীক্ষাকেন্দ্রে অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও ফলাফলে উত্তীর্ণ হয়েছে।

যেসব চাকরির পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha যেসব চাকরির পরীক্ষা স্থগিত কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে সরকার - dainik shiksha কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে সরকার উত্তরায় গুলিতে ২ শিক্ষার্থী নিহত - dainik shiksha উত্তরায় গুলিতে ২ শিক্ষার্থী নিহত ছাত্রলীগ আক্রমণ করেনি, গণমাধ্যমে ভুল শিরোনাম হয়েছে - dainik shiksha ছাত্রলীগ আক্রমণ করেনি, গণমাধ্যমে ভুল শিরোনাম হয়েছে সহিংসতার দায় নেবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - dainik shiksha সহিংসতার দায় নেবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জবিতে আজীবনের জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আশ্বাস প্রশাসনের - dainik shiksha জবিতে আজীবনের জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আশ্বাস প্রশাসনের মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানালেন পলক - dainik shiksha মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানালেন পলক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032210350036621