সিলেটের জৈন্তাপুর তৈয়ব আলী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. মফিজুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে ফের তদন্তে নেমেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। তাকে নিয়ে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ এপ্রিল দেশে শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকমে ‘নিয়োগ অবৈধ, তবু তিনি ১০ বছর ধরে অধ্যক্ষ’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিলো। সে প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে তার বিরুদ্ধে ফের তদন্ত শুরু করা হয়েছে।
অভিযোগ তদন্তে ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে সিলেট সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবুল কালাম মো. রিয়াজকে। গত ২৯ ডিসেম্বর জৈন্তাপুর তৈয়ব আলী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষকে পাঠানো চিঠিতে তদন্তের বিষয়টি জানানো হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের চিঠিতে, গত ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ এপ্রিল দৈনিক শিক্ষাডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের আলোকে জৈন্তাপুর তৈয়ব আলী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. মফিজুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ তদন্ত করে ১২ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন : তবু তিনি ১০ বছর ধরে অধ্যক্ষ
তদন্ত কমিটির প্রধান সিলেট সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবুল কালাম মো. রিয়াজ বিষয়টি নিশ্চিত করে দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ইতোমধ্যে তারা সংশ্লিষ্ট কলেজ পরিদর্শন করে তদন্ত কাজ সম্পন্ন করেছেন, এখন একটি তদন্ত প্রতিবেদন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
জানা গেছে, ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা টিম অধ্যক্ষের নিয়োগ অবৈধ বলে প্রতিবেদন দেয় এবং নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে এমপিও বাবদ উত্তোলিত টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু, মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নির্দেশনাটি ধামাচাপা দিয়ে অধ্যক্ষ পদে বহাল থাকছেন মফিজুর রহমান। গত ১৮ বছরে মাত্র একবারের অভ্যন্তরীণ অডিটে নানা আর্থিক অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির চিত্র ফুটে উঠে।
সম্প্রতি বিভিন্ন দপ্তরে অধ্যক্ষ মফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে পাঠানো অভিযোগ ও দৈনিক শিক্ষাডটকমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত কলেজটির প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ ছিলেন লোকমান হোসেন। তিনি কর্মরত থাকা অবস্থায় সম্পূর্ণ অবৈধ পন্থায় ভুয়া নিয়োগ কমিটির মাধ্যমে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুলাই মো. মফিজুর রহমান চৌধুরী অধ্যক্ষ পদে অবৈধভাবে নিয়োগ লাভ করেন। এ নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বৈধ করার জন্য মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তার মাধ্যমে ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ অক্টোবর পুনরায় অবৈধভাবে নিয়োগ লাভ করেন। এ নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে মো. মফিজুর রহমান চৌধুরী নিজেই দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া, ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগদান দেখালেও ২০০২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠান তৈয়ব আলী কারিগরি কলেজ থেকে সরকারি বেতন-ভাতা গ্রহণ করেন তিনি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ মফিজুর রহমান চৌধুরী ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দেখিয়ে নিয়োগ লাভ করেন। তিনি এইচএসসি ও বিকম তৃতীয় শ্রেণি এবং মাস্টার্স পূর্ব ভাগে তৃতীয় শ্রেণি ডিগ্রীধারী। অর্থাৎ তার একাধিক তৃতীয় বিভাগ আছে। নিয়োগকালে ভুয়া তথ্য দিয়েছেন এবং কাম্য অভিজ্ঞতা না থাকায় মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অধ্যক্ষের নিয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
অধ্যক্ষ মফিজুর রহমান চৌধুরী এ প্রতিবেদনের জবাব দাখিলের পর ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্রডশিট জবাব অনুমোদনে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত দেয়। ব্রডশিট জবাবে দেখা যায়, অধ্যক্ষ মফিজুর রহমান চৌধুরীর নিয়োগ নিয়োগ বিধি সম্মত না হওয়ায় উত্তোলিত সমুদয় বেতন ভাতার সরকারি অংশের টাকা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয় তাকে। এমনকি অর্থ জমাদানের চালানের সত্যায়িত ছায়ালিপি পত্র জারির ৩০ দিনের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে অধ্যক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়। ব্রডশিটে অধ্যক্ষ মফিজুর রহমান চৌধুরী তৈয়ব আলী ডিগ্রি কলেজে যোগদানের পর তৈয়ব আলী কারিগরি কলেজ থেকে অতিরিক্ত উত্তোলিত টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দানের নির্দেশও দেয়া হয়েছিল।
এদিকে, কলেজের অভ্যন্তরীণ অডিটেও অধ্যক্ষের নানা অনিয়ম ও আর্থিক কেলেঙ্কারীর চিত্র ফুটে উঠেছে। গত ১৮ বছর ধরে তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করলেও তার মেয়াদকালে কলেজের অভ্যন্তরীণ অডিট হয়েছে মাত্র একবার।
সূত্র জানায়, ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দেখিয়ে নিয়োগসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সভাপতি মরহুম রশিদ হেলালী অধ্যক্ষ মো. মফিজুর রহমান চৌধুরীকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। কিন্তু, অধ্যক্ষের সহোদর ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতির প্রেসসচিব মোখলেছুর রহমান চৌধুরীর সুবাদে তিনি এ যাত্রায় পার পেয়ে যান।
জানতে চাইলে কলেজের অধ্যক্ষ মো. মফিজুর রহমান চৌধুরী মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে তার নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করার কথা স্বীকার করলেও এসব আপত্তি পরবর্তীতে নিষ্পত্তি হয়েছে বলে দৈনিক শিক্ষাডটকমের কাছে দাবি করেছেন। তবে, তিনি এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন।