স্কুলে ভর্তি ও টিউশন ফি নির্ধারণ হবে অঞ্চলেভেদে। আর স্কাউট, মিলাদসহ ২৮টির মতো কমন ফি নির্ধারণ করে দেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ৬ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জনগণের আর্থিক অবস্থা ভাল হলে মাসিক বেতন বেশি হবে, আর তুলনামুলক পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানের বেতন কম হবে। এ বিষয়ে শিগগিরই আদেশ জারি করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচচশিক্ষা বিভাগ।
একদিকে বিষয়টিকে প্রশংসা করা যায়, আবার অন্যদিকে তাকালে দেখা যায়, বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করা হয়নি। আরও একটি অস্পষ্টতা লক্ষ্য করা যাচেছ এ প্রস্তাবিত উদ্যোগটির মধ্যে। এটি কি সরকারি আর বেসরকারি মিলে নাকি শুধু বেসরকারির ক্ষেত্রে তা স্পষ্ট নয়। আমরা জানি যে, সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের বেতনে আকাশ পাতাল তফাৎ!
দেশের সরকারি স্কুলগুলো সাধারণত অপেক্ষাকৃত ভাল ও স্বচছল এলাকায় অবস্থিত। বিশেষ করে উপজেলা ও জেলা সদর এবং বিভাগ ও রাজধানীতে। এসব এলাকায় বাস করেন অপেক্ষাকৃত সচছল ও সচেতন শ্রেণির নাগরিক, তাদের ছেলেমেয়েরাই সরকারি স্কুলে পড়াশুনা করেন। অভিভাবকরা সাধারণত ব্যবসায়ী, চাকরিজীবি ইত্যাদি। বস্তিবাসী, ভ্যানচালক, মজুর, খেটে খাওয়া মানুষের ছেলেমেয়েদের পড়তে হয় বেসরকারি বিদ্যালয়ে, যেখানে বেতন কমপক্ষে একশত টাকা থেকে শুরু হয়ে চার পাচশত টাকা পর্যন্ত। আর সরকারি স্কুলে বেতন হচেছ দশ-বিশ টাকা।
এছাড়াও বেসরকারি বিদ্যালয়ের মধ্যে কযেক ধরনের বিদ্যালয় রয়েছে, যেমন-- এমপিওভুক্ত, এমপিওবিহীন, ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান, কিন্ডারগার্টেন। এছাড়াও রয়েছে সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত বেশ কিছু নামীদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব বিষয় কিন্তু স্পষ্ট করা হয়নি।
ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে, এমনকি ঢাকার নিকটবর্তী অনেক এলাকার অনেক স্কুল শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো বেতন নেয় না, তারা শুধু এমপিওর ওপর নির্ভরশীল। আবার কিছু বিদ্যালয় ট্রাডিশনালি এবং বিশেষভাবে গঠিত কমিটির কারণে অথবা প্রধান শিক্ষকের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে এলাকায় সুনাম কুড়িয়েছে। এসব বিদ্যালয় শুধু একাডেমিক কার্যাবলীর মধ্যে সীমিত না রেখে শিক্ষার্থীদের মেধা ও নেতৃত্ব বিকাশের জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপ নিয়মিত আয়োজন করে থাকে। এসব বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য দূর দুরান্ত থেকে অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসেন। অনেক বিদ্যালয়ে আবাসিক ব্যবস্থা বিদ্যমান। এসব বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারা একটি ভাগ্যের ব্যাপার মনে করা হয়। এ ধরনের বিদ্যালয়ের কর্মচারীরাও প্রচলিত অন্যান্য বিদ্যালয়ের চেয়ে অনেকাংশে আলাদা। স্বভাবতই এসব প্রতিষ্ঠানে খরচপাতি একটু বেশি হয়, তাই ভর্তি ফি ও শিক্ষার্থী বেতনও একটু বেশি। ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এসব দিক বিবেচনায় নিতে হবে। এমনও যদি হয় যে, একটি অনুন্নত জেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেতন কম হবে তাহলেও বিষয়টি মানাচেছ না। কারণ জেলা অনুন্নত হলেও সব বিদ্যালয় অনুন্নত নয়। অন্যান্য জেলার মতো সেখানেও সরকারি স্কুল ও বেসরকারি এবং বিশেষ ধরনের বিদ্যালয় রয়েছে। এধরনের যেসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের উদ্যোগে অনে কদূর এগিয়েছে, ভাল মানের শিক্ষা প্রদান করছে, সেই উদ্যোগ দেশে আর হয়তো গ্রহণ করা হবে না যদি গড়ে সব ধরনের বিদ্যালয়ের বেতন একই ধরা হয় । বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মান সম্পন্ন শিক্ষা দানের প্রতিযোগিতাটিও আর থাকবে না।
তাই, প্রথম প্রয়োজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধরণ ঠিক করা, অর্থাৎ এক ধরনের র্যাঙ্কিং করা। মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের জন্য বিশেষ কিছু ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করা। সবচেয়ে বেশি ক্রাইটেরিয়া যে বিদ্যালয়গুলো পূরণ করবে সেগুলোর বেতন হতে হবে সবচেয়ে বেশি। সব নেই তবে অধিকাংশ ক্রাইটেরিয়া পূরণ করা বিদ্যালয়ের বেতন হতে হবে অন্য আর এক ধরনের। আর ক্রাইটেরিয়া একেবারেই পূরণ করে না সেগুলোর শিক্ষার্থীর বেতন ও ভর্তি ফি হবে একেবারে কম।
এসব বিবেচনায় না নিলে উদ্যোগের কোনো মূল্য থাকবে না। যেখানে শিক্ষার্থীদের বেতনের উপর নির্ভর করে বিদ্যালয়ের অন্যান্য কার্যাবলী পরিচালান করা হয়, সেখানে একটি ভাল মানের অর্থের প্রয়োজন। সেই সংকুলান বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের বেতন ও ভর্তি-ফি থেকেই আদায় করে। তবে, কেউ যাতে স্বেচ্ছাচারী হতে না পারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে একেবারে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে না পারে সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। কে দেবে, কিভাবে দৃষ্টি দেবে তারও একটি গাইডলাইন মন্ত্রণালয়কে ঠিক করে দিতে হবে। এলাকার রাজনৈতিক নেতা বা প্রভাবশালী ব্যক্তি যাতে এসব জায়গায় হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেই ব্যবস্থা আইনের মাধ্যমেই নির্ধারণ করতে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত হলো, জেলা পর্যায়ের স্কুলের বেতন নির্ধারণ করবেন জেলা প্রশাসন। আর সিটি করপোরেশন এলাকার স্কুলের ফি নির্ধারিণ করবে মাধ্যমিক ও উচচশিক্ষা অধিদপ্তরের আঞ্চলিক উপপরিচালক ও জেলা শিক্ষা অফিসারের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি। উপজেলা পর্যায়ে এই কাজটি করবে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির নেতৃত্বাধীন কমিটি। তবে এসকল বিষয়ে উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিসারদেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন পালন করতে হবে। কারণ উপজেলা ও জেলা প্রশাসন বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাদের পক্ষে এসব বিষয়ে যথাযথ নজরদারি সম্ভব নাও হতে পারে। তাই, উপজেলা ও জেলা শিক্ষা অফিসারদের এসব বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। তাদের শুধু বদলি, শিক্ষক নিয়োগে বোর্ডে থাকা আর অর্থিক সুবিধাদির দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। তারা নিজ থেকে যদি এসব বিষয়ে উদ্যোগ না নেন, নেতৃত্ব গ্রহণ না করেন তাহলে এই পদগুলো তাদের গুরুত্ব যতোটা হারিয়েছে, আরও হারাবে। কিন্তু হারাতে দেয়া ঠিক নয়! শিক্ষা অবহেলিত বলে বলে শ্লোগান তুললেও হবে না, নিজেদের এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক; ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক