গত বছর একটি টিভি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ভারতের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। বিচারপতি সেই সাক্ষাৎকারে স্পষ্টই জানিয়েছিলেন, স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘মুড়িমুড়কি’র মতো দুর্নীতি হয়েছিল। তাই তাঁকে মুড়িমুড়কির মতো সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে হয়েছে। এখন সেই সাক্ষাৎকারের জন্যই নিয়োগ সংক্রান্ত মামলার শুনানি থেকে সরানো হল বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে।
বিচারপতি বলেছিলেন, এত দুর্নীতি জীবনেও কল্পনা করতে পারি না।
এই নিয়োগে স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ যেভাবে কোর্টে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পেশ করেছিলো, তা থেকেই যে দুর্নীতির বিষয়টি সামনে এসেছিলো, তা-ও জানিয়েছিলেন তিনি। একই সঙ্গে জানিয়েছিলেন, তদন্তে সিবিআইয়ের ‘ঢিলেঢালা’ গতিতেও মাঝেমধ্যে বিরক্ত বোধ করেছেন তিনি। তবে তাঁর আশা, শেষ পর্যন্ত দোষিরা ধরা পড়বেন এবং সাজা পাবেন।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে চাকরি হারিয়েছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারী। সেই প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, যাঁরা জালিয়াতি করে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের চাকরি যাবে। ধরতে পারলেই চাকরি যাবে। তাঁরা যেন নিশ্চিন্তে না থাকেন। ‘বেআইনি পথে’ নিযুক্তদের সম্পর্কে বিচারপতির মন্তব্য, এঁরা কী শেখাবেন? এঁরা তো (বরং) স্কুলে টুকতে সাহায্য করবেন!
সাধারণত বিচারপতিরা সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন না। যদিও বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তিনি যে সাক্ষাৎকার দিয়ে ভুল করেননি, তা-ও জানিয়েছিলেন। তাঁর কথায়, বিচারপতিরা কী করতে পারেন এবং কত দূর যেতে পারেন, তা ব্যাঙ্গালোর প্রিন্সিপল-এ স্পষ্ট করা আছে। বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। বিচারপতিরও বাক্স্বাধীনতা আছে।
সাক্ষাৎকারে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে দেখা হওয়ার কথাও উঠে এসেছিল। সেই প্রসঙ্গে বিচারপতি জানিয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর ব্যবহার তাঁর ‘অত্যন্ত ভদ্র’ বলে মনে হয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘আপনি নিজের কাজ করে যান’ বলেছিলেন বলে জানিয়েছেন। সেই মন্তব্যে বিচারপতি কোনও ‘ক্রুরতা’ খুঁজে পাননি।
পুরো সাক্ষাৎকারে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বার বার তুলে ধরেছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই। জানিয়েছিলেন, ওই লড়াই আপসহীনভাবে লড়ে যাবেন। তিনি জানিয়েছিলেন, এজলাসে বসে তাঁর নানা পর্যবেক্ষণ এবং মন্তব্য তাঁর নিজের ‘শক্তি’। এজলাসে বসে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সারমেয়র ফ্ল্যাট নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। এ দিন সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওঁর ঘনিষ্ঠ এক প্রোমোটারের ফ্ল্যাটে কুকুর থাকত। নাকতলায় আমার বন্ধুরা আছে। তাঁদের কাছ থেকেই জেনে বলেছিলাম।
ক্যানসার আক্রান্ত চাকরিপ্রার্থী সোমা দাসকে যাতে নিয়োগ করা যায়, তা সরকারকে সহমর্মিতার সঙ্গে বিবেচনা করতে বলেছিলেন বিচারপতি। সোমা চাকরি পেয়েছেন। সেই প্রসঙ্গও উঠে এসেছিল সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেছিলেন, আমি তো সরাসরি কোনও নির্দেশ দেইনি। তবুও মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষা দফতর সোমাকে নিয়োগ করায় আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। আমি তো রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মাইনি। বেকারত্বের কষ্ট বুঝি।
এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকার পাওনাগন্ডা সরকারি আধিকারিকেরা না-মেটানোয় কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি। তাঁর নির্দেশ পেয়েই শিক্ষা দফতর প্রবীণার পাওনাগন্ডা মেটায়।
নির্দেশ দেওয়ার সময় অনেক ক্ষেত্রেই এজলাসে তাঁর মধ্যে আবেগের বহিঃপ্রকাশ ধরা পড়ে। এই প্রশ্নও করা হয়েছিল বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, মানুষ হিসাবে মানুষের দুর্দশায় তাঁর আবেগ ফুটে ওঠে। কিন্তু বিচার শেষে রায়দানের ক্ষেত্রে আবেগ নয়, তথ্য এবং যুক্তিকেই তিনি প্রাধান্য দেন। নিম্ন আদালতে পরিকাঠামোর অভাবও তুলে ধরেছিলেন তিনি। বিচারপ্রার্থী এবং বিচারপ্রাপ্ত নাগরিকের যে ফারাক রয়েছে, তা-ও জানিয়েছিলেন। এখন সেই সাক্ষাৎকারের জন্যই নিয়োগ সংক্রান্ত মামলার শুনানি থেকে সরানো হল বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে।