হাইকোর্টে মামলা না করেই প্রস্তুত করা হয়েছে আদেশ। প্রস্তুতকৃত ঐ জাল আদেশে যে তারিখ দেওয়া হয়েছে সেদিন ছিল শুক্রবার। বন্ধের দিন উল্লেখ করে উচ্চ আদালতের দুই বিচারপতির নাম ব্যবহার করে এই জাল আদেশ প্রস্তুতের ঘটনা ধরা পড়েছে। এই জাল আদেশ প্রস্তুত করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবৈধভাবে চারটি ইটভাটা পরিচালনার সুযোগ নেওয়া হয়েছে।
শুধু এই চারটি ইটভাটাই নয়, চট্টগ্রামের দুটি পরিবহন কোম্পানির ট্রেডমার্ক ব্যবহার নিয়ে চলমান দ্বন্দ্বে প্রস্তুত করা হয়েছে উচ্চ আদালতের জাল আদেশ। একের পর এক এই জাল আদেশ প্রস্তুত ও তা ধরা পড়ার ঘটনা ঘটছে উচ্চ আদালতে। আনা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের নজরেও। সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বিচারপতিরা এ ধরনের জাল আদেশ প্রস্তুতের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণে রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছেন। ঐ নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে মামলাও দায়ের হয়েছে। কিন্তু বেপরোয়া এই জালিয়াত চক্রের লাগাম কোনোভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এএম আমিন উদ্দিন বলেন, আমরা প্রায়শই দেখতে পাচ্ছি মামলা না করেই জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে উচ্চ আদালতের আদেশ প্রস্তুত করছে একটি চক্র। সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চারটি ইটভাটা পরিচালনা নিয়ে একটি জাল আদেশ সৃজন করা হয়েছে। যাতে অবৈধ ইটভাটগুলো চলতে পারে। যেখানে মামলাই করা হয়নি সেখানে এ ধরনের আদেশ প্রস্তুত করা ভয়াবহ অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, যেসব কোর্টের বিচারপতিদের নাম ব্যবহার করে এ ধরনের জাল আদেশ প্রস্তুত করা হচ্ছে সেই সব বেঞ্চ থেকে জড়িতদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে আদেশ দেওয়া হচ্ছে। এই আদেশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি কতটুকু সেটা সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের ফলোআপে রাখা দরকার। তাহলে এ ধরনের জালিয়াতি বন্ধ করা সম্ভব। এই ফলোআপ না থাকায় জালিয়াতি রোধে তৎপর হচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো।
শুধু মামলা না করেই জাল আদেশ প্রস্তুতের পাশাপাশি অস্ত্র, হত্যা, ধর্ষণ মামলাসহ বিভিন্ন গুরুতর অপরাধের মামলায় উচ্চ আদালতের সঙ্গে প্রতারণা করে হাসিল করা হয়েছে একের পর এক জামিন। মামলার মূল এজাহার, জব্দ তালিকা, চার্জশিট এমনকি অধস্তন আদালতের রায় ও আদেশও পালটে দিয়ে জামিন জালিয়াতির ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এসব জালিয়াতির ঘটনায় কখনো মামলার তদবিরকারক, কিছু অসাধু আইনজীবী ও আইনজীবী সহকারীর নাম উঠে এসেছে। বছরের পর বছর এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনা নজরে আসার পর সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে মামলা করা হয়েছে। কিন্তু সেই সব মামলার তদন্ত ও বিচারের অগ্রগতি কতটুকু সেই বিষয়ে সর্বশেষ কোনো তথ্য নেই রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের গুরুতর অপরাধের মামলার তদন্ত ও বিচারের বিষয়টি সব সময় তদারকি করা দরকার।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুন নূর দুলাল বলেন, এ ধরনের জাল-জালিয়াতির ঘটনা রোধে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। বিচার বিভাগকে বারের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। অতীতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে কিনা জানি না তবে আমি আলোচনার উদ্যোগ নেব। তিনি বলেন, এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনায় যেন কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত না হন সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার, যাতে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে না চাপে। তবে মামলা না করেই যারা জাল আদেশ প্রস্তুতের অপরাধে জড়িত তাদের কঠোর হস্তে দমন করা দরকার, এক্ষেত্রে প্রশাসনকে বার সকল ধরনের সহযোগিতা করবে।
জাল আদেশ পর্যালোচনা
‘মামুন মিয়া ও অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য’ নামক রিট মামলায় গত ১৮ অক্টোবর আদেশ দেয় হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ। ঐ আদেশে প্রশাসনের সিদ্ধান্তের ওপর স্থিতিবস্থা ও রুল জারি করে হাইকোর্ট। এই রিট মামলার আবেদনকারীর মামুনের নাম ঠিক রেখে অন্য আবেদনকারীর নাম বদলে দিয়ে সেখানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চারটি ইটভাটার মালিকদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে জাল আদেশ প্রস্তুত করেছে জালিয়াতি চক্র। পাশাপাশি বিবাদীদের নামও বদলে ফেলা হয়েছে। এছাড়া ১৮ অক্টোবরের পরিবর্তে হাইকোর্টের আদেশদানের তারিখ দেখানো হয়েছে ২৩ সেপ্টেম্বর। ঐদিন ছিল শুক্রবার, সরকারি ছুটির দিন। এমনকি ঐ বেঞ্চের দায়িত্বপালনকারী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের নামও পালটে দেওয়া হয়েছে। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসাবে যার নাম দেওয়া হয়েছে তিনি ঐ বেঞ্চে এক বছর আগে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে এই জালিয়াতির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনা হয়। এরপর হাইকোর্ট প্রকৃত রিট মামলার নথি তলব করে জালিয়াতির স্পষ্টত প্রমাণ পায়। এই জালিয়াতির ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। একই সঙ্গে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখার কোনো কর্মকর্তা এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কিনা তা তদন্ত করতেও কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন বিচারপতি জাফর আহমেদ ও বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামানের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ। এই জালিয়াতির ঘটনা উদ্ঘাটনের পূর্বে দুই পরিবহন ব্যবসায়ীর মধ্যে ‘হানিফ’ ট্রেডমার্ক ব্যবহার করা নিয়েই এক পক্ষ কোনো ধরনের মামলা না করেই হাইকোর্টের জাল আদেশ সৃজন করে সুবিধা নিয়েছেন। এ ধরনের ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করে জাল আদেশ প্রস্তুতের সঙ্গে কারা জড়িত তা তদন্তের জন্য রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী এবাদত হোসেনের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ।