বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২৯ বছরের বেশি বয়সীদের উত্তীর্ণের হার খুবই কম। সর্বশেষ চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হওয়া ৪৩তম বিসিএসেও যারা বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ২৯ বছরের বেশি বয়সের প্রার্থী ছিলেন কেবল ১ দশমিক ৭১ শতাংশ।
বর্তমানে দেশে সর্বোচ্চ ৩০ বছর পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে আবেদন করা যায়। আর অবসরে যাওয়ার সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৫৯ বছর। তবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ অন্যান্য কোটার ক্ষেত্রে এ বয়সসীমা ৩২ বছর, অবসরে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৬০ বছর নির্ধারণ করা আছে। এর মধ্যে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩৫ বছর করার দাবিতে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আন্দোলন করে আসছে চাকরিপ্রার্থীরা। চাকরিপ্রত্যাশীরা বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছে এ নিয়ে নিজেদের দাবি জানিয়ে আসছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও কয়েক দফায় কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। ‘চাকরিতে বয়সের আবেদনসীমা ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ’ ব্যানারে করা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।
সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার বিষয়টি পর্যালোচনায় ৩০ সেপ্টেম্বর একটি কমিটি গঠন করে সরকার। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের এ কমিটিতে সদস্য সচিব করা হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমানকে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বয়স বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গত ২ অক্টোবর বৈঠকে বসে সরকার। সেদিন কমিটির প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, সেশনজট, করোনাসহ বিভিন্ন কারণেই চাকরিতে প্রবেশের বিদ্যমান বয়সসীমা বাড়ানো উচিত।
এর পর সবকিছু যাচাই-বাছাই শেষে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর যৌক্তিকতা দেখিয়ে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছে পর্যালোচনা কমিটি। এদিকে পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রজ্ঞাপন জারির জন্য তিনদিনের সময় বেঁধে দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। আর সেটি না হলে আবারো আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়ে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করেছেন তারা।
এ বিষয়ে আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র ইমতিয়াজ হোসাইন দৈনিক শিক্ষাডটজকমকে বলেন, ‘আমাদের আবেগকে বর্তমান সরকার মূল্যায়ন করেছে এবং তারা একটি কমিশন গঠন করেছে। যেহেতু এ কমিশন আমাদের যুক্তি শুনে কথা বলে ও গবেষণা করে পুরুষের জন্য ৩৫ ও নারীদের জন্য ৩৭ বছর করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, আমরা চাই সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দ্রুত প্রজ্ঞাপন জারি করা হোক।’
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় থাকলেও এটির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। সরকারের সাবেক আমলাদের কেউ কেউ মনে করছেন, চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হলে বেকারের হার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি তা দেশের জন্য বোঝাও তৈরি করতে পারে।
বিসিএস কিংবা সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে আবেদনের পর লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা শেষে কেবল সুপারিশপ্রাপ্ত হলেই চলে না; পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ নানা আনুষ্ঠানিকতা থাকে। আর এসব শেষ করে চাকরি হতে তিন থেকে চার বছর সময় লেগে যায়। সেক্ষেত্রে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর হলে তাদের কর্মজীবনই শুরু হবে প্রায় ৩৮ বছর বয়সে।
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) বার্ষিক প্রতিবেদনেও দেখা যায়, ৪৩তম বিসিএসে অংশ নেন মোট ৪ লাখ ৪২ হাজার ৮৩১ জন। চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মাত্র ২ হাজার ১৬৩ পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৩ থেকে ২৫ বছর বয়সী উত্তীর্ণ হয়েছিলেন ৩৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এছাড়া ২১ থেকে ২৩ বছর বয়সীদের উত্তীর্ণের হার ছিল ১৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ, ২৫ থেকে ২৭ বছর বয়সীদের ৩২ দশমিক ২৭ শতাংশ, ২৭ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ ও ২৯ বছরের ঊর্ধ্বে বয়সীদের বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণের হার ছিল ১ দশমিক ৭১ শতাংশ।
৪২তম বিসিএসে (বিশেষ) উত্তীর্ণ হন মোট আট হাজার প্রার্থী। ওই পরীক্ষায় ২৫ থেকে ২৭ বছর বয়সসীমার প্রার্থীদের উত্তীর্ণের হার ছিল সবচেয়ে বেশি ৩৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আর ২৯ ঊর্ধ্বদের উত্তীর্ণের হার ছিল ১১ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। এছাড়া ২১ থেকে ২৩ বছর বয়সীদের মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২৩ থেকে ২৫ বছর বয়সী ২৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ ও ২৭ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ২০ দশমিক ৪৩ শতাংশ উত্তীর্ণ হয়েছিলেন ওইবারের পরীক্ষায়।
মেধার সব ধাপ পেরিয়ে ৪১তম বিসিএসে ক্যাডারের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন মোট ২ হাজার ৫১৬ প্রার্থী। তাদের মধ্যে ২৩ থেকে ২৫ বছর বয়সসীমার প্রার্থীদের উত্তীর্ণের হার ছিল সবচেয়ে বেশি। ওই বয়সসীমার ৩৯ দশমিক ৯০ শতাংশ উত্তীর্ণ হন। এছাড়া ২১ থেকে ২৩ বছর বয়সীদের উত্তীর্ণের হার ১৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ, ২৫ থেকে ২৭ বছর বয়সী প্রার্থীদের উত্তীর্ণের হার ২৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ, ২৭ থেকে ২৯ বছর বয়সসীমার প্রার্থীদের হার ১১ দশমিক শূন্য ৫ এবং ২৯ ঊর্ধ্ব বয়সসীমার প্রার্থীদের হার ছিল ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
পিএসসি ৪০তম বিসিএসে মোট ১ হাজার ৯৬৩ জনকে বিভিন্ন পদের জন্য সুপারিশ করেছিল। তাদের মধ্যে ২৩ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের উত্তীর্ণের হার ১৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ২৫ থেকে ২৭ বছর বয়সীদের ৩৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ, ২৭ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের ৩০ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং ২৯ ঊর্ধ্ব বয়সীদের উত্তীর্ণের হার ১৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসক সংকট কাটাতে তৎকালীন সরকার ৩৯তম (বিশেষ) বিসিএসের মাধ্যমে কেবল স্বাস্থ্য ক্যাডারে নিয়োগ দিয়েছিল। সেবার চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন ৪ হাজার ৭৯২ জন। তাদের মধ্যে ২১ থেকে ২৩ বছর বয়সীদের উত্তীর্ণের হার ১ দশমিক ৯৩ শতাংশ, ২৩ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের ২০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, ২৫ থেকে ২৭ বছর বয়সীদের ৩৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, ২৭ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের ৩০ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং ২৯ ঊর্ধ্ব বয়সীদের উত্তীর্ণের হার ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ।
পিএসসি ৩৮তম বিসিএসের মাধ্যমে মোট ২ হাজার ২০৪ জনকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছিল। তাদের মধ্যে ২৩ থেকে ২৫ বছর বয়সীরাই সবচেয়ে বেশি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সে হার ছিল ৪২ দশমিক ১১ শতাংশ। এছাড়া ২১ থেকে ২৩ বছর বয়সীদের উত্তীর্ণের হার ছিল ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ, ২৫ থেকে ২৭ বছর বয়সীদের ৩২ দশমিক ৭১ শতাংশ, ২৭ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং ২৯ ঊর্ধ্বদের উত্তীর্ণের হার ২ দশমিক ৪১৪ শতাংশ।
পিএসসির সাবেক সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনের মতে, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই রয়েছে। তিনি দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ‘বিসিএসের ক্ষেত্রে দেখেছি ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে সাফল্যের হার সবচেয়ে বেশি এবং বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সাফল্যের হার কম। এর একটি কারণ হতে পারে একজন সদ্য গ্র্যাজুয়েট যখন কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নেন, তখন তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অর্জিত জ্ঞানকে অনেক বেশি কাজে লাগাতে পারেন। এছাড়া তারা তুলনামূলক চাপমুক্ত থাকেন। অপরদিকে যারা পাঁচ-ছয় বছর আগে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক জ্ঞানের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়। সেই সঙ্গে পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন চাপও বেশি থাকে। ফলে সাকসেস রেট কমে যায়।’
সাবেক একজন শিক্ষা সচিব বলেন, তিনবারের বেশি বিসিএস পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ বন্ধ করা দরকার। যত তরুণদের নিয়োগ দেওয়া যাবে তত উপকৃত হবে দেশ।