বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ক্রমাগত বেড়ে চলছিল অশ্লীলতা। ছাত্রনেতাদের নারীসহ হলের অতিথি কক্ষে রাত্রিযাপন, অপ্রীতিকর ভিডিও ছড়িয়ে পড়া, অপ্রীতিকর অবস্থায় আটক থেকে শুরু করে লুঙ্গি দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় নবজাতক উদ্ধারের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এমন অপ্রীতিকর ঘটনার ছড়াছড়ির ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন এক অশ্লীলতার নিরাপদ স্থানরূপ ধারণ করেছিল।
বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু নির্দিষ্ট এলাকাতে যেমন কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, কার্জন হল, শহীদুল্লাহ্ হল পুকুর পাড়, মহসিন হল খেলার মাঠ, মল চত্বর ও গুরুদুয়ারা নানকশাহীর দেয়াল ঘেঁষে আমতলাতে পর্যাপ্ত লাইটিংয়ের ব্যবস্থা না থাকার সুযোগে অনেক তরুণ-তরুণী অশ্লীলতায় লিপ্ত হতো। এই অশ্লীলতা কখনো সংঘটিত হচ্ছে বহিরাগতদের দ্বারা, আবার কখনো শিক্ষার্থীদের দ্বারা।
প্রেমিক যুগলের এসব আপত্তিকর দৃশ্যে প্রায়শই অস্বস্তিতে পড়তেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরতে আসা শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক থেকে শুরু করে যে কেউ। অপ্রীতিকর ঘটনায় আটককৃতদের ছাত্রনেতাদের হস্তক্ষেপ বা আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে ছেড়ে দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও মাঝে মাঝে শিক্ষকরা যুগলদের এসব অশ্লীল কার্যক্রম বন্ধে বাধা দিলে তাদের সম্মানহানিও ঘটানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব অশ্লীলতা বন্ধে নিয়েছে নানা পদক্ষেপ; চালানো হচ্ছে নিয়মিত অভিযান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসের দেয়া তথ্য অনুসারে, গত জুন মাস থেকে কার্জন হল এলাকায় নিয়মিত অভিযান চালিয়ে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল টিম। গত ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব অভিযানে ৩১৩ প্রেমিক যুগলকে আপত্তিকর অবস্থায় আটক করে পরবর্তীতে কার্জন হল এলাকায় আর না আসার শর্তে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে যাদের একবার মুচলেকা নেয়া হয়েছে তারা আর পরবর্তীতে কার্জন হল এলাকায় আসেননি এবং পূর্বের তুলনায় পরিবেশ উন্নত হয়েছে বলে জানায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সরেজমিনে কার্জন হল এলাকায় দেখা যায়, বহিরাগত প্রবেশ বন্ধে মূল গেটের মাঝে একটি পকেট গেট বানানো হয়েছে। এতে করে যে কেউ গাড়ি কিংবা নির্বিঘ্নে সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন না। এছাড়া মূল গেটের পাশে টাঙানো হয়েছে সতর্কতামূলক নোটিশ বোর্ড। যেখানে লেখা আছে, ‘এলাকাটি সিসি টিভি ক্যামেরার আওতাধীন। কার্জন হল এলাকায় বহিরাগত ও সাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রিত ও অবস্থান সম্পূর্ণ নিষেধ; অ্যাকাডেমিক ভবনে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ছাড়া অবস্থান করা নিষেধ; বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকার সম্বলিত যানবাহন ছাড়া অন্যান্য যানবাহনের প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত।’
ভেতরে প্রবেশ করেই চোখে পড়ে যেসব জায়গায় যুগলরা বেশি আপত্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করতেন, সেসব জায়গায় নতুন নতুন লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাস্তার পাশে, ভবনের সামনে বিভিন্ন জায়গায় লাগানো হয়েছে সতর্কতামূলক নোটিশ বোর্ড। যেখানে লেখা, ‘এলাকাটি সিসি টিভি ক্যামেরার আওতাধীন। অ্যাকাডেমিক ভবনে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ছাড়া অবস্থান করা নিষেধ।’
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ রকম উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ সমুন্নত রাখতে বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত অভিযানসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে কার্জন হল এলাকায় আগে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে যে অস্বস্তিতে পড়তে হতো তা এখন অনেকটাই কমে এসেছে। ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি গুরুদোয়ারা নানকশাহীর দেয়াল ঘেঁষে আমতলাতে কার্যক্রম জোরদারের দাবি জানায় শিক্ষার্থীরা।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ও অশ্লীলতা বন্ধে নিয়মিত টহলসহ সিসি টিভি ক্যামেরা বৃদ্ধির কাজ অব্যাহত রয়েছে বলে জানান সহকারী প্রক্টর ড. হাসান ফারুক। তিনি বলেন, আমরা সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন টহল দিচ্ছি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা নিয়মিত টহল দিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপকারীদের চিহ্নিত করে আটক করেছি। আটককৃতরা পরবর্তীতে কার্জন হল এলাকায় না আসার ও অসামাজিক কার্যকলাপ না করার লিখিত শর্তে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। অনেকের অভিভাবককে ডেকে এনে এসব বিষয় জানানো হয়েছে।
অসামাজিক কার্যকলাপ জিরো লেভেলে আনার প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, পুরো কার্জন এলাকায় এখন পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে, কিছু জায়গাতে এখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন রয়েছে সেই জায়গাগুলোতে আমরা পর্যাপ্ত লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করতেছি। সেই সঙ্গে সিসিটিভি ক্যামেরা বাড়ানোর কাজও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীদের নিকট আমাদের নম্বর দেয়া আছে, তারা কোনো ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ দেখলে আমাদের জানায়। আমরা সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পূর্বের তুলনায় উন্নত হয়েছে বলেও জানান তিনি।
অভিযানের ধারা অব্যাহত থাকবে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমান। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার জন্য যেকোনো কিছুই হোক এগুলোকে এক এক করে আমরা সমাধান করার চেষ্টা করছি। আমরা এটা (অভিযান কার্যক্রম) আজকে করলাম এ রকম না; এর ধারা অব্যাহত থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দুস্থ ও ভ্রাম্যমাণ মানুষের অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত থাকা বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, দুস্থ ও ভ্রাম্যমাণ মানুষকে জোর করে উৎখাত না করে সামাজিক সুরক্ষা বলয়ে আনার জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও সমাজ সেবা অধিদপ্তরে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে চিঠি দিয়েছিলাম। তবে এখনো কোনো সাড়া পাইনি আমরা। এক্ষেত্রে পুলিশ অনেকটা তৎপর রয়েছে।