সদ্য স্বাধীন যে কোনো দেশ গড়ে তুলতে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখতে হয় মধ্যবিত্তকে। তবে বসেই মধ্যবিত্তের শক্তির উৎস হলো প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এমন একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত প্রজন্ম গড়ার ব্রত নিয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ অনেকটা একক প্রচেষ্টা ও দৃঢ় মানসিকতা নিয়ে ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর গড়ে তোলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। 'আলোকিত মানুষ চাই' স্লোগান নিয়ে বই পড়ার মাধ্যমে সমাজ বদলে তাঁর সে স্বপ্নের সংগঠন হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজ অতিক্রম করেছে প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছর। পথ চলার এই সাড়ে চার দশকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র 'বই পড়া কর্মসূচি', 'ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি'-সহ নানা উদ্যোগের মাধ্যমে লাখো শিশু-কিশোর-তরুণদের শুধু জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধই করেনি, একইসঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের সেরা কাজগুলোর সঙ্গেও। বইয়ের মাধ্যমে সমাজ বদল আন্দোলনে অধ্যাপক সায়ীদের স্বপ্ন আজ ডালপালা মেলেছে আরো বহু মানুষের মধ্যে। সেজন্যই কয়েক প্রজন্ম এখন যুক্ত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে।
গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছর অতিক্রম করেছে। সাধারণত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পাঁচ বছর পরপর প্রতিষ্ঠা উৎসব উদযাপন করে।
তাই সে সময় তেমন কোনো আয়োজন না থাকলেও, নতুন বছরে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে এসে আজ শুক্রবার প্রতিষ্ঠানটি নানা আয়োজনে দিনব্যাপী উদযাপন করবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনন্দ। দিনের বিভিন্ন আয়োজনের মধ্যে আছে শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আড্ডা ইত্যাদি। এর মধ্যে শোভাযাত্রায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত এবং শুভাকাঙ্ক্ষী সহস্রাধিক মানুষ অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। শোভাযাত্রায় গ্রাম-বাংলার গুর ইতিহাস ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ, মানুষের জীবনযাত্রা, উৎসব, আনন্দসহ বহুমাত্রিক বিষয় উঠে আসবে বলে জানিয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। এ ছাড়া উৎসব উপলক্ষে আজ প্রকাশ হচ্ছে একটি বিশেষ স্মরণিকা। থাকছে দেশবরেণ্য ব্যক্তিবর্গ, সাধারণ মানুষ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রাক্তন ও বর্তমান সদস্য, শুভানুধ্যায়ীদের উপস্থিতিতে সাংস্কৃতিক আয়োজন।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাবিষয়ক নানা কথা উঠে এসেছে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখা 'বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও আমি' বইয়ে। সেখানে তিনি লেখেন, 'অনেক দিন পর্যন্ত আমি সত্যি সত্যি চেষ্টা করেছি মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় কোথাও এটার অফিস নিতে, জাতির কর্মমুখর বাস্তবতা এবং হিংস্র উদ্যমের মূল প্রাণকেন্দ্রে।... এই কেন্দ্র থেকে পাঠ নিয়ে একদিন যাদের এই জাতিকে দিকনির্দেশনা দিতে হবে, আমি বিশ্বাস করি, তাদের উত্থিত হতে হবে এই জাতির সর্বময় রাষ্ট্র প্রক্রিয়ার বাস্তব ভিত্তিমূল থেকে।' বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লক্ষ্য সম্পর্কে অধ্যাপক সায়ীদ বলেছিলেন, '... আমি জানি, এই কেন্দ্রের সামনে আজ যদি সত্যিকার করণীয় কিছু থাকে, তবে তা হচ্ছে দুটো। এক, আজকের তরুণদের অর্থাৎ আগামী দিনের মানুষদের বড় করে তোলা। দুই, তাদের সংঘবদ্ধ জাতীয় শক্তিতে পরিণত করা।'
জানা গেছে, প্রায় দুই মাস ধরে আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করেছে উৎসব উদযাপন কমিটির সদস্য, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবকরা। সাজসজ্জা ও বিভিন্ন উপকরণ তৈরির জন্য রাজধানীর বাংলামটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনে প্রতিদিন প্রায় ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়মিত কাজ করছেন। আয়োজকরা জানান, ৪৫ বছর পূর্তি উৎসবে প্রায় ১০ হাজার মানুষের প্রীতি সমাবেশ ঘটবে। উদযাপন কমিটি কয়েকটি উপকমিটিতে ভাগ হয়ে প্রায় দুই মাস ধরে কাজ করেছে। সরকারের বিভিন্ন সেবা সংস্থা, অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করছে এ উৎসবে।