দেশের ৬৯ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিকে উন্নয়নে প্রধান বাধা হিসেবে দেখেন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবকে ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় প্রাধান্য দেয়াকে ৩২ দশমিক ৬ শতাংশ এবং প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার-সমন্বয়ের অভাবকে ২৮ দশমিক ১ শতাংশ তরুণ উন্নয়নে প্রধান বাধা মনে করেন। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ-এর এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এক মাসে পাঁচ হাজার ৭৫ জন তরুণ (১৮-৩৫) অনলাইন জরিপে অংশ নেন। এছাড়া ২৮টি তরুণ নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠান, ২০টি ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন ও গত ১০ বছরের লিটারেচার রিভিউয়ের মাধ্যমে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। গতকাল রাজধানী ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের অডিটরিয়ামে যুব সম্মেলন ২০২৩-এ জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের আহ্বায়ক ও সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি, বড় অংশই তরুণ। তাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। বাংলাদেশের এখন সবচেয়ে বড় সম্ভাবনাময় জনশক্তি যুবরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি দশকে এই বয়সীদের সংখ্যা ও অনুপাত বাড়ছে। ২০০১ সালে ছিল ২৯ শতাংশ, ২০১১ সালে ২৯ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরে নতুন ভোটার হয়েছে সাড়ে তিন কোটি তরুণ। এই যুবসমাজের আশা-আকাক্সক্ষা প্রত্যাশা আগামী দিনের বাংলাদেশে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যুক্ত করতে আমরা কতটুকু সফল, কতটুকু কার্যকর, কতটুকু ফলপ্রসূ এই জিজ্ঞাসাটা আমাদের বারবার আসছে। এই জিজ্ঞাসার ভেতরে একটা বড় জিজ্ঞাসা হলো রাষ্ট্র, দেশ, রাজনীতি, সমাজনীতি, পেশা পরিচালনার ক্ষেত্রে ঘর-সমাজের ভূমিকা আমরা বজায় রাখতে পারছি কি না এবং সেই ভূমিকা বাড়ানোর একটা বড় জায়গা হলো গণতন্ত্রের চর্চা করার ক্ষেত্রে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সামনের নির্বাচনে আমরা যুব সমাজের অংশগ্রহণকে আরও জোরদারভাবে দেখতে চাই, আশা করি নির্বাচন নিয়ে যে সমস্ত সংশয়, বিভ্রান্তি বা উদ্বেগ আছে সেগুলো আগামী দিনে কেটে যাবে।’
জরিপে দেখা গেছে, তরুণরা সম্প্রতি অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার, শিক্ষায় অভিগমন এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বৃদ্ধির মতো বিষয়ে সাফল্য এসেছে বলে মনে করেন।
যুব জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উন্নয়নের অগ্রাধিকার হিসেবে দুর্নীতি দমন, জবাবদিহিতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেছেন ৫৬ দশমিক ২ শতাংশ। ৫৫ দশমিক ৪ শতাংশ উল্লেখ করেছেন মানসম্মত শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধি। ৪০ দশমিক ২ শতাংশ জরিপ অংশগ্রহণকারী তরুণ দেশ ও দেশের বাইরে কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিয়েছেন।
জরিপে দেখা যায়, ৬০ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ মনে করেন, রাজনীতিতে জড়িত তরুণরা কার্যত সাধারণ তরুণদের প্রায় সবসময় প্রতিনিধিত্ব করেন। অন্যদিকে ৩০ শতাংশ মনে করেন একদমই করেন না। ২৪ দশমিক ২ শতাংশ মনে করেন, করলেও তা খুবই কম। ৩৭.৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন, স্ব-স্ব এলাকায়/জাতীয় নীতিনির্ধারণে রাজনৈতিক নেতারা সাধারণ তরুণদের সঙ্গে নিজ থেকে আলোচনা একদমই করে না। ২১ দশমিক ৭ শতাংশ মনে করেন আলোচনা করলেও তা খুবই কম।
৬৭ দশমিক ৮ শতাংশ মনে করেন সরকারের বাইরে থাকা সামাজিক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) অথবা নাগরিক সমাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বা তাদের মাধ্যমে উন্নয়ন ও নীতিতে মতামত প্রকাশ করা সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতামত প্রকাশ করা সমর্থন করেছেন ৫৯ দশমিক ৬ শতাংশ।
৬০ দশমিক ৪ শতাংশ যুব জরিপ অংশগ্রহণকারী বেকারদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করার পক্ষে। ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ শ্রমিকদের জন্য মৌলিক জীবনযাত্রার খরচ মেটাতে সক্ষম এমন মজুরি প্রদান করার পক্ষে। ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ যুব উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা এবং ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিরোধী বিভিন্ন আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বাতিল করার দাবি জানান।
জরিপে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে তরুণদের মতামত উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী সুযোগ পেলে স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে যেতে চান। উচ্চশিক্ষিতের মধ্যে এ ধরনের মনোভাব তুলনামূলকভাবে বেশি। আরও ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী অস্থায়ীভাবে চাকরি বা পড়াশোনা করতে বিদেশে যেতে চান। ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেন, যুবসমাজ আগামী দিনে দেশের নেতৃত্ব/দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। ৪৬ শতাংশ মনে করেন, যদি নীতি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আসে তাহলে তরুণরা প্রস্তুত।
যুব সম্মেলনে জরিপের ফলাফল উপস্থাপনের পাশাপাশি সংসদীয় বিতর্ক আয়োজন করা হয়। সম্মেলনের আয়োজন করে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ। সমর্থনে ছিল প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল। ‘দেশ হোক তেমন যুবরা চায় যেমন’ স্লোগানে যুব সম্মেলনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন সংগঠনের কর্মী, শিক্ষক, গবেষক, সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিসহ অনেকে অংশ নেন। সম্মেলনে জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।