২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুলাই শবেবরাতের রাতে ঢাকার আমিনবাজারের বড়দেশি এলাকায় বেড়াতে যাওয়া সাত বন্ধুর জীবনে নেমে এসেছিল অবর্ণনীয় এক বিভীষকা। ডাকাত সন্দেহে মাদক কারবারি, সন্ত্রাসী ও ডাকাতদের উন্মত্ত হামলার শিকার হয়ে মারা যান ছয় শিক্ষার্থী। বেঁচে ফিরলেও পঙ্গুত বরণ করেন আল আমিন। অথচ সেই ঘটনায় মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশ পাওয়া পাঁচজনকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখছেন তিনি। এই আসামিদের গ্রেফতারে পরোয়ানা জারি করা আছে।
এই পাঁচজন হলেন আসামি মজিবুর রহমান, যাবজ্জীবন সাজার আসামি সাত্তার, টোটন, শাহিন আহমেদ ও মোবারক হোসেন।
স্থানীয় ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পলাতক এই আসামিদের সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগ আছে। তারা প্রায়ই এলাকায় আসেন। তাদের প্রকাশ্যে দেখা গেছে।
গণপিটুনিতে নিহত কামরুজ্জামান কান্ত ও বেঁচে থাকা তার বন্ধু আল আমিন দারুস সালাম এলাকার নৌকার পাড় এলাকার বাসিন্দা। বড়দেশি এলাকাটি দারুস সালামের কাছেই।
কান্তর বাবা মো. সুরুজ বলেন, ‘ওরা আমার ছেলেকে ডাকাত বানিয়েছিল। রায়ে সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। টাকার জোরে সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত অনেকেই জামিনে আছেন, আবার কেউ পলাতক। ওরা যদি বিচারের আওতায় আসে, তাহলে এতগুলো মানুষের চাওয়া পূরণ হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকাশ্যে পিটিয়ে আমার সন্তানদের মেরে ফেলল। আদালত রায় দিল, কিন্তু তাদের সাজা কার্যকর তো হলো না। উল্টো মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে প্রকাশ্যে ঘুরছেন ফাঁসির আসামি! বেড়াচ্ছে। প্রায় সময় তাদের এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। আশা করি, প্রশাসন তাদের গ্রেপ্তার করবে। সবার সাজার রায় কার্যকর করবে।’
পিটিয়ে হত্যার শিকার হওয়া ছয় শিক্ষার্থী হলেন, ধানমন্ডির ম্যাপললিফ স্কুলের ‘এ’ লেভেলের ছাত্র শামস রহীম শাম্মাম, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইব্রাহিম খলিল, বাংলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুর রহমান পলাশ, তেজগাঁও কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র টিপু সুলতান, মিরপুরের বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সিতাব জাবীর মুনিব এবং বাঙলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র কামরুজ্জামান কান্ত। তারা ছিলেন দারুস সালাম, কল্যাণপুর ও শ্যামলীর বাসিন্দা।
যে ঘটনায় আল আমিনের পরিবারসহ আরও ছয়টি পরিবার তছনছ হয়েছে, সেই ঘটনার পরদিন হামলাকারীরা সাত ছাত্রের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় ডাকাতির মামলা দেয়। বেঁচে যাওয়া আল আমিনের বক্তব্যে পাল্টে যায় পটভূমি। যারা মামলা দিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা মামলা করে। মামলাটি পুলিশ, অপরাধ তদন্ত বিভাগের হাত ঘুরে আসে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) হাতে। র্যাব ৬০ জনকে অভিযুক্ত করে চূড়ান্ত অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে।
প্রায় ১১ বছর পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মামলার রায় দেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ইসমত জাহান। রায়ে ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনকে যাবজ্জীবন ও অভিযুক্ত ২৫ জনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার সাত দিন পরে মৃত্যুদন্ড দেওয়া আসামিদের ডেথ রেফারেন্স পৌঁছায় উচ্চ আদালতে। এ মামলাটি এখনো বিচারাধীন।
আসামিদের মধ্যে পলাতক পাঁচজন ছাড়া কবির হোসেন, রাশেদ ও ছাব্বির আহমেদ ওরফে পর্বত মামলা চলাকালে মারা যাওয়ায় তাদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ভুক্তভোগীর পরিবার ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ মামলায় যাবজ্জীবন সাজার আরও নয় আসামি বর্তমানে জামিনে মুক্ত আছেন।
সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ ঘটনা যখন ঘটে, তখন আমি চাকরিতেই ছিলাম না। তাই খুব বেশি কিছু জানি না। তারপরও আমরা সব সময় আদালতের পরোয়ানাভুক্ত পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে তৎপর থাকি।’
রায় দেখে যেতে পারলেও আসামিদের সাজা কার্যকর দেখে যেতে পারেননি শাম্মামের বাবা এসএম আমিনুর রহীম। ছেলের শোকে এক প্রকার কাঁদতে কাঁদতেই জীবনাবসান হয়েছে ইব্রাহিমের মায়ের। তার বাবাও ঢাকা ছেড়ে থাকছেন মাদারীপুরে। ছেলের শোক ভুলতে সুদূর আমেরিকাপ্রবাসী মেয়ের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন পলাশের মা-বাবা। মুনিবের বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দেখে যেতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন টিপুর বাবা। কামরুজ্জামান কান্তর বাবা-মা দুজনই সাজা কার্যকর দেখে মরতে চান। ছেলের পর স্বামী হারিয়ে শোকে পাথর নিয়ে দিনাতিপাত করছেন টিপুর মা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘অনেকের বাবা-মা বিচার না দেখেই মারা গেছেন। আমার টিপুর বাবাও ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দেখে যেতে পারে নাই। আমি ওই হত্যাকারীদের ফাঁসি দেখে মরতে চাই। ওদের সাজা যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়।’
আল আমিন বলেন, ‘সেদিনের ঘটনার পরে আমি প্রায় পঙ্গু। ভারী কোনো কাজ করতে পারি না। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এখনো বাবার ওপর বোঝা হয়ে আছি। আমাকে যেভাবে কোপানো হয়েছিল, তাতে আমার পক্ষে আর স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব না। আয় রোজগারও করতে পারি না।’
আল আমিনের বাবা মো. হবি ব্যাপারী বললেন, ‘বাবারে, আর কী কমু? এই বয়সে আমার পোলার কামাই খাওনের কথা। অথচ হইল কী? এডি কইতেও পারি না, বুকডা ফাইডা যায়।’
আল আমিনের মা শিল্পী বেগম বললেন, ‘আমরা না থাকলে পোলাডার কী হইব?’