অন্তরালে থাকতেই পছন্দ করতেন তিনি; চলে গেলেন অনন্তের পথে। বাংলাদেশের ইতিহাসের এক জীবন্ত অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটল প্রায় নিভৃতে। স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রধান সংগঠক সিরাজুল আলম খান আর নেই। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল শুক্রবার দুপুরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে জাসদ প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর এই বাম তাত্ত্বিকের বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এক শোকবার্তায় তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান রাষ্ট্রপতি। শোক জানিয়েছেন বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতা এবং দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও।
বাংলাদেশের রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিত সিরাজুল আলম খান দীর্ঘদিন থেকে উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রমণসহ নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। গত ৭ মে থেকে রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল তাঁর। ২০ মে তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১ জুন তাঁকে কেবিন থেকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১১টায় সিরাজুল আলম খানকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। শুক্রবার বেলা আড়াইটায় চিকিৎসকরা লাইফ সাপোর্ট খুলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দেও অসুস্থ হয়ে কিছুদিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি।
চিরকুমার সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর পর তাঁকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানো হোক– তা চায় না পরিবার। তাঁর ছোট ভাই ফেরদৌস আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, ভাই সব সময় প্রচারণার বাইরে থেকেছেন। তিনি বলে গেছেন, তাঁকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা না হয়। এমনকি দাফনের সময় তাঁকে কাফনের বদলে মায়ের কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে দাফনের ইচ্ছার কথা জানিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মায়ের শাড়িটাই আমার কাছে পতাকা। আমি এ পতাকা নিয়েই চলে যেতে চাই।’
সিরাজুল আলম খানের ছোট ভাইয়ের মেয়ে ব্যারিস্টার ফারাহ খান জানান, আজ শনিবার সকাল ১০টায় বায়তুল মোকাররম মসজিদে তাঁর জানাজা হবে। এর পর বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দ্বিতীয় এবং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে তৃতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হবে। ব্যারিস্টার ফারাহ খান বলেন, চাচা বলে গেছেন– ‘মৃত্যুর পরে আমাকে কোথাও রাখার দরকার নেই। আমাকে যেন ডিসপ্লে করা না হয়। আমার জন্য হাজার হাজার ফুল আসার দরকার নেই। আমি দেশটা স্বাধীন করতে চেয়েছিলাম। আমি স্বাধীন করতে পেরেছি। সেটাই আমার বড় অর্জন। আমি কারও কাছে কিছু চাই না।’
‘প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান’ বইতেও সিরাজুল আলম খান তাঁর শেষ ইচ্ছা এভাবে প্রকাশ করেছেন– ‘আমার মৃত্যুর পর কোনো শোকসভা হবে না। শহীদ মিনারে ডিসপ্লে হবে না লাশ। যত দ্রুত সম্ভব নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আমার গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হবে মরদেহ, যা ঢাকা থাকবে একটা কাঠের কফিনে। মায়ের একটা শাড়ি রেখে দিয়েছি। কফিনটা শাড়িতে মুড়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, মায়ের কবরে।’
তাত্ত্বিক এই নেতার ঘনিষ্ঠ সহচর ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন পাটোয়ারী জানান, তাঁর শেষ নির্দেশনা ছিল– মৃত্যুর পর তাঁর মুখ যেন কাউকে দেখতে না দেওয়া হয়। এ কারণে মায়ের শাড়িতে মুড়িয়ে তাঁকে দাফন করা হবে।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীসহ অনেকেই। তাঁর গড়ে তোলা রাজনৈতিক দল জাসদের সব অংশের নেতারা হাসপাতালে উপস্থিত হন। জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন পাটোয়ারী, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া, বাসদের উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর প্রমুখ হাসপাতালে গিয়ে প্রয়াত এই নেতার পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।
সিরাজুল আলম খানের জন্ম ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে। তিনি ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ষাটের দশকের প্রথমার্ধে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার ‘নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয়। পরে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তাঁরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলেন এই ছাত্রনেতারা।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হয় তাঁর উদ্যোগেই। তিনি কখনও নেতৃত্বে না এলেও জাসদ নেতাদের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ হিসেবে পরিচিত। তাঁকে সবাই ‘দাদা ভাই’ নামেই ডাকেন। তবে তিনি কখনও জনসমক্ষে আসতেন না এবং বক্তৃতা-বিবৃতিও দিতেন না। আড়ালে থেকে তৎপরতা চালাতেন বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রহস্য পুরুষ হিসেবে পরিচিতি পান। দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়ে আসা চিরকুমার সিরাজুল আলম খান রাজধানীর কলাবাগানে ভাইদের সঙ্গেই থাকতেন।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে আরও শোক জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম, সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, নির্বাহী সমন্বয়কারী আবু হাসান রুবেল, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণফোরামের একাংশের সভাপতি মোস্তফা মহসীন মন্টু, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা, জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি আব্দুল কাদের হাওলাদার, সাধারণ সম্পাদক বাদল খান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চেয়ারপারসন অধ্যাপক আলতাফুন্নেসা, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (বিসিএল) সভাপতি গৌতম চন্দ্র শীল, সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান প্রমুখ।
সিরাজুল আলম খানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জাসদ আজ শনিবার শোক পালন করবে। ভোর ৬টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে।