গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানের উন্মেষ ঘটানো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান কাজ। বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মৌলিক গবেষণা কার্যক্রম চলে মূলত পিএইচডি প্রোগ্রাম ঘিরে। সে লক্ষ্য নিয়েই গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি) ২০১৪ সালে একটি স্বতন্ত্র ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। বঙ্গবন্ধু ইনস্টিটিউট অব লিবারেশন ওয়ার অ্যান্ড বাংলাদেশ স্টাডিজ (বিলওয়াবস) নামে ওই ইনস্টিটিউটের মূল উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উচ্চতর গবেষণার মাধ্যমে এমফিল ও পিএইচডি দেয়া। অথচ কোনো অধ্যাপক, এমনকি সহযোগী অধ্যাপক ছাড়াই সেই গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
জানা যায়, বিলওয়াবসের রূপরেখা তৈরি করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (আইবিএস) আদলে। প্রথম পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়নের অধ্যাপক শহীদুল ইসলামকে। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে এমফিল প্রোগ্রামে তিন শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে শুরু হয় ইনস্টিটিউটের একাডেমিক কার্যক্রম। এর পরের শিক্ষাবর্ষে পিএইচডি প্রোগ্রামে তিনজন এবং ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে আরো দুই শিক্ষার্থী ভর্তি হন এমফিল প্রোগ্রামে। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর অধ্যাপক শহীদুল ইসলামের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। এরপর আর কাউকেই তার চেয়ারে বসানো হয়নি। পদাধিকারবলে ইনস্টিটিউটের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন উপাচার্য নিজেই। তবে শহীদুল ইসলাম চলে যাওয়ার পর এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির জন্য আর কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বশেমুরবিপ্রবির গবেষণা ইনস্টিটিউটে বর্তমানে শিক্ষক রয়েছেন ছয়জন—চারজন সহকারী অধ্যাপক ও দুজন প্রভাষক। উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানকারী ইনস্টিটিউটের শিক্ষক হলেও তাদের পাঁচজনেরই নেই কোনো এমফিল কিংবা পিএইচডি। ফলে প্রত্যেক ফেলোকেই সুপারভাইজার ঠিক করে আনতে হয়েছে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরবর্তী সময়ে ইনস্টিটিউট তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অবশ্য দাবি করছে, ইনস্টিটিউটের সংবিধিতে চুক্তির মাধ্যমে সুপারভাইজার নিযুক্তের সুযোগ রয়েছে এবং সে অনুযায়ীই সবকিছু করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) যদিও বলছে, এভাবে একটি ইনস্টিটিউট পরিচালনার সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার সুবিধার্থে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পারে। কিন্তু যেকোনো গবেষণা প্রোগ্রাম পরিচালনার জন্য সেই প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম একজন নিজস্ব অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক থাকা বাধ্যতামূলক।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রিসার্চ ও উচ্চতর ডিগ্রি-সংক্রান্ত বিষয় দেখভাল করে ইউজিসির রিচার্স সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন ডিভিশন। এ বিভাগের দায়িত্বে থাকা ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেনবলেন, ‘আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভালো গবেষণা হোক, ভালো গবেষক তৈরি হোক এটা আমরা সবসময় চাই। কিন্তু গবেষণা অবশ্যই মানসম্মত হতে হবে। নিজস্ব একজনও অধ্যাপক ছাড়া এমফিল বা পিএইচডির মতো প্রোগ্রাম চালানোর সুযোগ নেই। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি যাতে মানসম্মত হয় এ বিষয়ে আমরা কাজও করছি। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে কারা শিক্ষক, সুপারভাইজার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারভাইজার হতে পারবেন এরই মধ্যে সে বিষয়ে আমরা নির্দেশনা দিয়েছি।’
অভিযোগ রয়েছে, বিলওয়াবস উচ্চতর গবেষণার জন্য বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট হলেও শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সবকিছুই করা হচ্ছে স্নাতক পর্যায়ে পাঠদানের মতো। ফলে পূরণ হচ্ছে না ইনস্টিটিউটের মুখ্য উদ্দেশ্য। সর্বশেষ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানকারী এ ইনস্টিটিউটে শিক্ষক নিয়োগে ৬ আগস্ট এক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তাতে এমফিল ও পিএইচডি-সংক্রান্ত কোনো শর্তই দেয়া হয়নি। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সমাজবিজ্ঞান ও কলা অনুষদভুক্ত সব বিভাগের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরাই বিলওয়াবসে আবেদন করতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্রার্থীদের কেবল ইউজিসির নীতিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে। অথচ একই ধরনের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএসে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এমফিল ও পিএইচডির পাশাপাশি গবেষণায় অভিজ্ঞতা বাধ্যতামূলক।
বিলওয়াবসের বর্তমান ও সাবেক একাধিক শিক্ষক জানান, দীর্ঘদিন ধরেই ইনস্টিটিউটে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব। গবেষণায় আগ্রহী হলেও জ্যেষ্ঠ শিক্ষক না থাকায় পর্যাপ্ত দিকনির্দেশনা পাচ্ছেন না সদ্য যোগদানকৃত শিক্ষকরা। গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩টি বিভাগে স্নাতক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু অ্যান্ড বাংলাদেশ স্টাডিজ কোর্স পড়ানো হয়। ইনস্টিটিউটের শিক্ষকরা মূলত এ কোর্সের শিক্ষক হিসেবেই অধিকাংশ সময় ব্যয় করছেন।
পিএইচডির জন্য সাধারণত চার বছর সময়ের প্রয়োজন হয়। অথচ বিলওয়াবসে ২০১৫ সালে নিবন্ধনকৃত ফেলোরা এখনো পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ সময়ক্ষেপণের জন্য ফেলোদের অবহেলাকেই দায়ী করছে। তবে ফেলোরা দায়ী করছেন প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনাকে। তারা জানান, পিএইচডির জন্য নিবন্ধিত তিনজন তাদের রিসার্চ পেপার জমা দিয়েছেন প্রায় এক বছর আগে। কিন্তু সেগুলো কীভাবে পর্যালোচনা করা হবে, তা নির্ধারিত না থাকায় মূলত এ সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। এছাড়া এমফিল প্রোগ্রামের দুই শিক্ষার্থী তাদের ডিগ্রি পিএইচডিতে স্থানান্তরের জন্য আবেদন করেছেন। বেশকিছু জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টির মীমাংসা হচ্ছে না।
বিলওয়াবসের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বশেমুরবিপ্রবির উপাচার্য ড. একিউএম মাহাবুবও। তিনি বলেন, ‘এটি ঠিক যে একটি উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানকারী ইনস্টিটিউটের যে ধরনের সক্ষমতা থাকা দরকার তা আমাদের নেই। তবে এর সম্পূর্ণ দায় আমাদের নয়। ইনস্টিটিউটে একজন অভিজ্ঞ পরিচালক নিয়োগ দেয়ার জন্য আমি কয়েক মাস ধরে চেষ্টা করছি। কিন্তু যারা এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ তারা এখানে আসতে চান না। আমরা অধ্যাপক তো দূরের বিষয়, বিভিন্ন বিভাগে একাধিকবার সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিলেও যোগ্য কাউকে পাইনি। সিনিয়র শিক্ষকরা অধিকাংশই ঢাকার বাইরে আসতে চান না।’
ড. একিউএম মাহাবুব আরো বলেন, ‘বিলওয়াবসের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার পরিকল্পনা আছে। তবে তার জন্য সহযোগিতা প্রয়োজন। ইউজিসি শিক্ষার মান নিশ্চিত করার কথা বলে কিন্তু আমরা যখন শিক্ষক চাই, কর্মকর্তা-কর্মচারী চাই তারা প্রয়োজন অনুযায়ী এসব পদ অনুমোদন দেয় না। পর্যাপ্ত বাজেট দেয় না। তারা এসব না দিলে আমরা কীভাবে মান নিশ্চিত করব?’