অনলাইন ক্লাস: কয়েকটি সাধারণ করণীয় - দৈনিকশিক্ষা

অনলাইন ক্লাস: কয়েকটি সাধারণ করণীয়

মো. রহমত উল্লাহ্ |

মহামারি করোনার ভয়াবহ বিরূপ পরিস্থিতিতে যখন প্রায় ঘরবন্দি ছিলো অদম্য মানবজাতি, তখন বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছে যে, শিক্ষা-কার্যক্রম চালানোর জন্য অনলাইন ক্লাসের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে এই অবস্থার উন্নতি হলেও ডিজিটাল সুবিধার কারণে স্বাভাবিক ক্লাসের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলমান রয়েছে অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রম। স্মার্ট বিশ্বের স্মার্ট বাংলাদেশে অবশ্যই আরো ভিন্নতা পাবে, বৃদ্ধি পাবে, আধুনিক হবে অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষা। তাই অপরিহার্যভাবেই চলমান রাখতে হবে অনলাইন ক্লাসের উৎকর্ষ সাধন। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, আপনাদের মেধায় ও প্রচেষ্টায়ই ক্রমাগত সাধিত হবে সেই উৎকর্ষ। শিক্ষকের যোগ্যতা ও দক্ষতার পাশাপাশি আরও অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে একটি অনলাইন ক্লাসের সফলতা। চলুন লক্ষ করা যাক, অনলাইন ক্লাসে শিক্ষকের কয়েকটি সাধারণ করণীয় বিষয়: 

এক. প্রয়োজন ও পছন্দ অনুসারে বোর্ড, মার্কার, ডাস্টার, স্টিক, লাইট, প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, স্মার্টফোন, স্মার্টপ্যাড এবং অন্যান্য অভিনব শিক্ষা উপকরণ রেডি-সেটিং করে রেকর্ডিং বা লাইভ শুরু করতে হবে। রেকর্ডিং বা লাইভ শুরু করে এসব ঠিকঠাক করা অশোভন।

দুই. নিজে ভালোভাবে তৈরি হয়ে ক্যামেরার সামনে আসতে হবে। সবার সামনে এসে বার বার নিজেকে ঠিক করা দৃষ্টিকটু ও বিরক্তিকর। এতে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ পাঠের বাইরে চলে যায়। তাই চুল, চশমা, এয়ারফোন, জামাকাপড় ইত্যাদি এমনভাবে সেট করে আসতে হবে যেনো ক্লাস চলাকালে বার বার ঠিক করতে না হয়।

তিন. স্বাভাবিক সাজপোশাক ধারণ করে নিজে অত্যন্ত পরিপাটি থাকতে হবে। এমন সাজ-পোশাক ধারণ করা উচিত নয় যাতে শিক্ষার্থীর মনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। নিজের ঘর থেকে অনলাইন ক্লাস সম্প্রচার করা হলেও পোশাকের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। 

চার. খাটে, দেয়ালে, চেয়ারে বা অন্য কোথাও হেলান দিয়ে বা বিছানায় শুয়ে শুয়ে বা কোনো কিছু খেতে খেতে ক্লাস নেওয়া উচিত নয়। 

পাঁচ. যথাসম্ভব সুন্দর রাখতে হবে ক্লাসের ব্যাকগ্রাউন্ড। অগোছালো পর্দা, অপরিচ্ছন্ন দেয়াল, ভাঙ্গা আসবাবপত্র, বাথরুমের দরজা ইত্যাদি ব্যাকগ্রাউন্ডে না থাকাই উত্তম। 

ছয়. ব্যাকগ্রাউন্ডে কোনো ডিস্টার্বেন্স এলিমেন্টস থাকা কোনোভাবেই উচিত নয়। খোলা দরজা-জানালা, চলমান ফ্যান, কারো যাওয়া-আসা ইত্যাদি যেনো শিক্ষার্থীদের চোখে না পড়ে। বাড়তি সাউন্ড, গান-বাজনা, ডাক-চিৎকার ইত্যাদিও যেনো শিক্ষার্থীদের কানে না পৌঁছে। 

সাত. এমন ক্যামেরা ও নেট কানেকশন সেট করতে হবে যেনো ছবি ও সাউন্ড পরিষ্কার থাকে এবং খেয়াল রাখতে হবে যেনো সেখানে বাড়তি কোন নয়েজ না থাকে।

আট. যথাসম্ভব ক্যামেরা (বিশেষ করে মোবাইল ফোন সেট বা ল্যাপটপের ক্যামেরা) মুখের সমান্তরালে সেট করতে হবে। কেননা ক্যামেরা মুখের বেশি উপরে বা নিচে সেট হলে অবয়ব বিকৃত দেখায়। তাতে শিক্ষকের চেহারা শিক্ষার্থীদের কাছে উদ্ভট লাগতে পারে। 

নয়. মোবাইল ফোনসেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে অটো রোটেট অপশনটি একটিভ করে নিতে হবে এবং ফোনসেটটি ল্যান্ডস্কেপ পজিশনে রাখতে হবে বা সেটিং করতে হবে; যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের ডিভাইজে সর্বাবস্থায় বোর্ডের ও শিক্ষকের ছবি ফুলস্ক্রিনে সোজা দেখতে পান।

দশ. ক্যামেরা থেকে যুক্তিযুক্ত দূরত্বে থাকতে হবে। ক্যামেরার এতো কাছে থাকা যাবে না যাতে পুরো স্ক্রিন জুড়ে শুধু মুখ অস্বাভাবিক বড় দেখায়। আবার ক্যামেরার এতো দূরে থাকা যাবে না যাতে চিনতে অসুবিধা হয়। বসে ক্লাস নিলে পাসপোর্ট সাইজের ছবির আকার ও দাঁড়িয়ে ক্লাস নিলে হোয়াইট বোর্ডের বটম লেভেলের উপরে অবস্থিত শরীরের অংশ দেখা যায় এমনভাবে ক্যামেরা সেট করা উচিত।   

এগারো. সুবিধা ও সক্ষমতা বিবেচনা করে Zoom, Google Class Room, Edmodo, Facebook Live ইত্যাদি যে কোনো এক বা একাধিক কার্যকরী অ্যাপ ব্যবহার করে ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। সম্ভব হলে অধিক ইন্টারেক্টিভ অ্যাপ ব্যবহার করাই উত্তম। অ্যাপ ইন্টারেক্টিভ হোক বা না হোক, এমন মনে করতে হবে যে, ক্লাসে সকল শিক্ষার্থী উপস্থিত আছেন এবং তারা সবাই দেখতে ও শুনতে পাচ্ছেন।

বারো. শিক্ষার্থীদের সাথে সীমিতভাবে শুভেচ্ছা বিনিময় করা যাবে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, স্বাগতম ভুল, স্বাগত সঠিক। এজন্য অতি অল্প সময় ব্যয় করা উচিত এবং একান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে আলোচনা করা উচিত নয়।

তেরো. সম্বোধন করার সময় ছাত্রীরা, মেয়েরা, ছাত্ররা, ছেলেরা -এভাবে না বলে 'প্রিয় শিক্ষার্থী' 'আপনি' ‘আপনারা' বলা উত্তম। শিক্ষার্থীরা যতো নিচের শ্রেণিতেই পড়ুক না কেনো, যতো নিকটজনই হোক না কেনো, কখনোই তাদের 'তুই' 'তোরা' বলা শোভন নয়। 

চৌদ্দ. অবশ্যই প্রথমে বোর্ডে বা স্লাইডে ক্লাসের তারিখ, শিক্ষকের নাম, শ্রেণি-শাখার নাম, বিষয় ও অধ্যায়ের নাম ইত্যাদি লেখা এবং বলা প্রয়োজন।

পনেরো. ক্লাসের শুরুতে শিখন ফল লেখা ও বলা আবশ্যক। হতে পারে তা অতি অল্প কথায়। একটি ক্লাসে দুই-তিনটি শিখনফল রাখাই উত্তম, যেনো ক্লাসটি বেশি দীর্ঘ না হয়।

ষোলো. নিয়মমাফিক পাদটিকা তৈরি করে ও অনুসরণ করে ক্লাস নিতে হবে। হতে পারে তা অলিখিত ও সংক্ষিপ্ত। ক্লাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সঠিক সময় বিভাজনের প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি। 

সতেরো. অতি দ্রুত বা অতি ধীরে ক্লাস পরিচালনা করা উচিত নয়। অতি দ্রুত হলে যেমন সব শিক্ষার্থী বুঝতে পারে না, তেমনি অতি ধীর হলেও অনেক শিক্ষার্থী বিরক্ত বা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন।

আঠারো, অবশ্যই প্রতিটি বর্ণ, শব্দ ও বাক্য শুদ্ধভাবে বড় অক্ষরে লিখতে এবং সঠিক উচ্চারণে উচ্চ স্বরে বলতে হবে। প্রয়োজনে কোন কোন শব্দ/বাক্য আন্ডারলাইন করে একাধিকবার বলতে হবে। যেনো সকল শিক্ষার্থী তা স্পষ্টভাবে দেখতে, শুনতে ও বুঝতে পারেন। 

ঊনিশ. কথা বলার সময় ও্য ও্য, এ্য এ্য, আ্য আ্য, ইয়ে ইয়ে, ইত্যাদি মুদ্রাদোষ অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে। বিশেষ করে রেকর্ডেড ক্লাসগুলো বারবার শুনতে গেলে এ সব মুদ্রাদোষ শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই বিরক্তির কারণ হয় এবং ক্লাসগুলো শুনতেই ইচ্ছে করে না।  

বিশ. একসাথে অনেক কথা বা একাধিক পয়েন্ট লেখা/বলা/ উপস্থাপন করা অনুচিত। এতে শিক্ষার্থীরা কোনোটির প্রতিই মনোযোগ দিতে পারেন না। পৃথক পয়েন্ট বা শিরোনাম লেখায় একাধিক কালার ব্যবহার করা উত্তম।

একুশ. আলোচ্য বিষয়ের উপযোগিতা অনুসারে বোর্ডে ও/বা স্লাইডে পাঠ উপস্থাপন করা উচিত। যেমন: গণিত ধাপে ধাপে বোর্ডে লিখে ও বলে বুঝানো উত্তম এবং হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া ভিডিওতে দেখানো উত্তম। আবার বোর্ডে এঁকে বা স্লাইডে দেখানো যেতে পারে ফুল-ফলের ছবি।

বাইশ. নিজে অত্যন্ত উদ্যমী, প্রাণোচ্ছল ও হাসিখুশি থাকতে হবে। এতে পাঠের প্রতি শিক্ষার্থীর আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। শিক্ষার্থীর অর্থাৎ ক্যামেরার সামনে এসে কথা বলা উত্তম। 

তেইশ. আলোচিত পাঠের সম্ভাব্য প্রশ্ন ও উত্তর নিজে নিজেই একাধিক বার লেখা এবং বলা অত্যাবশ্যক। বিশেষ করে ক্লাস ইন্টারেক্টিভ না হলে অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করার সুযোগ না থাকলে এ কাজে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। যেনো অতি দুর্বল শিক্ষার্থীও তার প্রায় সকল প্রশ্নের উত্তর এমনিতেই পেয়ে যান।

চব্বিশ. ক্লাস শেষ করার আগে একাধিক বার পাঠের মূল অংশ বা শিখন ফল পুনরুল্লেখ করা ও লেখা আবশ্যক। যেনো আলোচিত পাঠটি শিক্ষার্থীরা ক্লাস থেকেই সর্বাধিক আয়ত্ত করতে পারে।

পঁচিশ. ফেস টু ফেস অনুষ্ঠিত কোন ক্লাস রেকর্ডিং করে অনলাইনে আপলোড করা হলে অথবা সরাসরি সম্প্রচার করা হলে ক্যামেরার ব্যবহার এমন হতে হবে যেনো (১৮০ ডিগ্রি কভার করার মতো) ক্লাসে অবস্থিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সকল অ্যাক্টিভিটিস দর্শক-শিক্ষার্থীরা সহজেই দেখতে-শুনতে পাযন।  
 
ছাব্বিশ. রেকর্ডিং বা লাইভ ক্লাস শেষ করে নিজের ক্লাস নিজেই একাধিকবার দেখা প্রয়োজন। যদি মনে হয় কোনো ক্লাস মানসম্মত হয়নি তো সেটি অনলাইনে আপলোড করা বা রাখা ঠিক না। পরবর্তীতে আরও ভালো করে এই ক্লাসটি সম্পন্ন করে অনলাইনে রাখা উচিত।

সর্বোপরি একজন আদর্শ শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারে পটু হয়ে এমনভাবে ক্লাস পরিচালনা করতে হবে যেনো শিক্ষার্থীরা বারবার এই ক্লাসটি উপভোগ করতে আগ্রহী হয় এবং তাদের জ্ঞান, দক্ষতা, আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির স্থায়ী অনুকূল পরিবর্তন সাধিত হয়; অর্থাৎ কাঙ্ক্ষিত শিখনফল অর্জিত হয়। 

লেখক : মো. রহমত উল্লাহ্, অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা  

 

চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ - dainik shiksha চট্টগ্রামে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ নিহত ২ ঢামেকে একজনের মৃত্যু - dainik shiksha ঢামেকে একজনের মৃত্যু জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ - dainik shiksha জবির কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ৪ বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ - dainik shiksha বেরোবিতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০০ শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর - dainik shiksha শহীদ মিনার এলাকায় অধ্যাপককে মারধর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের - dainik shiksha সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো - dainik shiksha যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ - dainik shiksha সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064928531646729