সাবিহা সুমি, দৈনিক শিক্ষাডটকম: গত ১৯ মে বিকেলে সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ আঞ্জুনুল ইসলামের এমপিওর ইনডেক্স ডিলিট করা হয়। ওইদিনই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে মে মাসের এমপিও কমিটির সভা হয়। সেখানে অবৈধভাবে এমপিওভুক্ত করা আঞ্জুনুলের নাম কাটা হয় এমপিওর সফটওয়ার থেকে।
এ ব্যাপারে সভাতেই মহাপরিচালককে জানানো হয়, তাকে (আঞ্জুনুল ইসলাম) ভুলক্রমে এমপিওভুক্ত করা হয়েছিলো। তবে বিষয়টি আসলে এতো সরল নয়। দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর কাহিনি।
গত ১৯ মে সকালে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে শিক্ষা অধিদপ্তরের তৃতীয় তলায় দেখা হয় এমপিওবঞ্চিত শিক্ষক শাহানা সুলতানার। স্বামীসহ তিনি দাঁড়িয়েছিলেন এমপিও কমিটির সভাস্থলের সামনে। হাতে আবেদন। তার চোখমুখ থেকে চরম বিরক্তি আর কষ্ট যেনো ঠিকরে বেরিয়ে আসছিলো।
শাহানা এই প্রতিবেদককে বলেন, সকাল নয়টায় জেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুল মজিদ তাকে সব কাগজ নিয়ে অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এস এম জিয়াউল হায়দার হেনরীর কক্ষে হাজির থাকতে বলেছেন। কিন্তু হেনরী তাদের কাগজপত্র দেখে বলে দিয়েছেন, এটা আঞ্চলিক উপ-পরিচালক ও ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসারের বিষয়। স্বামীসহ শাহানার শারীরিক উপস্থিতি বাধ্য করে এমপিও সিন্ডিকেটের অবৈধভাবে এমপিওভুক্ত করা আঞ্জুনুলকে বাদ দিতে। নইলে ধরা পড়তে হতো যে ওই সভাতেই!
জানা যায়, আঞ্জুনুলের আবেদন অনুমোদন করে জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে পাঠানোর জন্য স্থানীয় শিক্ষা অফিসারকে নানাভাবে হুমকি ও ভয় দেখানো হয়েছিলো। যেটা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
শাহানা সুলতানা রাজধানীর রাজউক উত্তরা আইডিয়াল হাইস্কুলের এমপিওবঞ্চিত সহকারী শিক্ষক। অবৈধভাবে আঞ্জুনুলকে এমপিওভুক্তির অভিযোগের শাস্তি দাবি করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছেন। ইনডেক্স নম্বর দেওয়া ও ডিলিট করার এখতিয়ারভুক্ত সবার শাস্তি চান শাহানা সুলতানা।
লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, তিনি ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত এবং তার নাম ব্যানব্যাইসে সংযুক্ত রয়েছে। একই প্রতিষ্ঠানের সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে কর্মরত আছেন আঞ্জুনুল ইসলাম। নিয়মানুযায়ী সিনিয়র হিসেবে যিনি কর্মরত আছেন এমপিওভুক্তির জন্য তিনি আগে সুপারিশপ্রাপ্ত হবেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠান প্রধান এই নিয়মের তোয়াক্কা না করে জুনিয়রকে এমপিভুক্তকরণের সব প্রক্রিয়া শেষ করেছেন। অবৈধভাবে এমপিওভুক্ত আঞ্জুনুলকে বাদ দেয়ার দাবি জানান শাহানা সুলতানা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা অফিসার আবদুল মজিদ দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, দুজনের আবেদন আসার কথা ছিলো, সেখানে একজন এসেছেন। আঞ্জুনুল ইসলামের ইনডেক্স ডিলিট হয়নি। কাগজ অনলাইনে আছে। সেটা আটকে রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত হবে। এটার সমাধান হলে যদি দুজন বৈধ থাকেন দুজনেরটাও হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর যদি একজন বৈধ থাকেন তাহলে একজনের হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর ভগ্নিপতি নওয়াব আলী মাস্টার ‘রাজউক উত্তরা আইডিয়াল হাইস্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় সুলতানাসহ ছয়জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। সুলতানা ছিলেন ওই সময়ে নিয়োগ পাওয়া একমাত্র নারী শিক্ষক। পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৫-তে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে অদ্যাবধি পাঠদান করছেন তিনি। প্রতিষ্ঠাকালে সকল শিক্ষককে আশ্বস্ত করা হয়, এমপিও হলে সবাইকে দেয়া হবে। কিন্তু বারবার বাদ পড়ছেন শাহানা সুলতানা।
২০২২ খ্রিষ্টাব্দে এমপিওভুক্ত হয় রাজউক উত্তরা আইডিয়াল হাইস্কুল। এরপর স্কুলের সিকিউরিটি গার্ডও এমপিও পেলেও কেবল বাদ পড়েছেন সুলতানা। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এখন পর্যন্ত নানাভাবে সুলতানার এমপিও পাওয়ার আবেদনের ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টির অভিযোগ ওঠেছে প্রধান শিক্ষক শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালকের কাছে এমপিওভুক্ত না হওয়া ও ইচ্ছাকৃতভাবে নাম বাদ দেয়ার বিষয়ে অভিযোগ করেছেন শাহানা সুলতানা।
বিদ্যালয় এমপিওভুক্তির পর সরকার নির্ধারিত জনবল কাঠামো বিধান অনুযায়ী এমপিও যাচাই-বাছাই কমিটি এমপিওভুক্তির যোগ্য হিসেবে প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনের পর ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে প্রথমবার প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীদের এমপিও আবেদন পাঠান। কিন্তু সেখানে বাদ দেয়া হয় সুলতানার নাম। এভাবে একে একে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দেই তিনবার এই শিক্ষিকার নাম বাদ দিয়ে আবেদন পাঠানো হয়। আর প্রতিবারই আবেদন ফিরিয়ে দেয়া হয়।
শিশু-কিশোরদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিলেও নিজের ঘরে আলো নেই মন্তব্য করে শাহানা সুলতানা বলেন, ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে আমি স্নাতক পাস করি। সেই সময়ে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব আলী মাস্টার আমাকে ডেকে এনে চাকরি দেন। কারণ, সেই সময়ে স্নাতক পাস কোনো নারী শিক্ষিকা পাচ্ছিলেন না। মাত্র ২২ বছর বয়সে শিক্ষকতা শুরু করি। এখন আমি একজন মধ্যবয়স্ক নারী। সেই সময়ে আমিসহ ছয়জন নিয়োগ পেয়েছিলাম। তখন থেকে নামমাত্র পারিশ্রমিকে চাকরি করে এসেছি।
শাহানা সুলতানা আরো বলেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েছিলো, এমপিওভুক্ত হলে বেতন বাড়বে। কিন্তু এখনো আমি মাত্র সাড়ে ৬ হাজার টাকা বেতন পাই। এই টাকা দিয়ে কী হয়? আমি চাকরিজীবী হলেও চলতে হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের টাকায়। এর চেয়ে কষ্টের কী আছে!
এদিকে, সুলতানাকে এমপিওভুক্তিতে সুযোগ না দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নিজেকে ‘নিরীহ’ দাবি করে রাজউক উত্তরা আইডিয়াল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, এটা নিয়ে অনেক কথা। অনেক বিধি, মন্ত্রণালয়, থানা, শিক্ষা অফিসে আছে। তাদের প্রশ্ন করেন। আমি নিরীহ মানুষ আমাকে করেন কেনো? স্কুল সভাপতি ও ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে, তাদের কাছে প্রশ্ন করেন।
দৈনিক শিক্ষা ডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।