দেবী দুর্গা হিন্দু ধর্মে শক্তির প্রতীক এবং মহাশক্তি রূপে পূজিত হন। তিনি মূলত দুষ্টের দমন ও সৃষ্টির পালন করার জন্য আগমন করেন। মহিষাসুর নামে এক অসুর, যার দ্বারা দেবগণ পরাজিত হয়েছিলেন, তাকে বধ করার জন্য দেবতারা একত্রিত হয়ে দেবী দুর্গার সৃষ্টি করেন। দুর্গা নামের অর্থই হলো ‘অভেদ্য’ বা ‘অজেয়’।
দেবী দুর্গা অসুর নিধন ও বিশ্বকে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য এক অসাধারণ প্রতীক। মহিষাসুর ব্রহ্মার কাছ থেকে বর পেয়েছিলো যে, কোনো পুরুষ তাকে বধ করতে পারবে না। সেই বরকে অতিক্রম করতে দেবতারা একত্রিত হয়ে দেবী দুর্গার সৃষ্টি করেন, যিনি নারী হয়ে মহিষাসুরকে পরাজিত করবেন।
দুর্গা পূজা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, অশুভ শক্তি যতই প্রভাবশালী হোক না কেনো, শুদ্ধ ও ন্যায়ের শক্তি সর্বদাই জয়ী হয়। দেবী দুর্গার এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং তাঁর রূপ বিভিন্ন দেবী রূপে তার শক্তির প্রতিফলন ঘটায়।
দেবী দুর্গার কাহিনী হিন্দু পুরাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি মহাশক্তির প্রতীক হিসেবে দেবীকে তুলে ধরে। দুর্গা দেবী প্রধানত দেবী মহামায়া বা আদ্যাশক্তি রূপে পূজিত হন। তার বিভিন্ন রূপের মধ্যে প্রধান রূপটি হলো মহিষাসুরমর্দিনী, যিনি মহিষাসুরকে বধ করেন। দেবী দুর্গার আদ্যপ্রান্ত বর্ণনা করতে গেলে অনেকগুরো পুরাণ ও শাস্ত্রের উল্লেখ করতে হয়। নিচে দেবীর কাহিনীর আদ্যপ্রান্ত উপস্থাপন করা হলো:
দেবী দুর্গার উত্পত্তি ও মহিমা
দেবী দুর্গার কাহিনী প্রধানত দেবী মহাত্ম্যম বা চণ্ডীপাঠে পাওয়া যায়, যা মার্কণ্ডেয় পুরাণের একটি অংশ। এই কাহিনী অনুযায়ী, এক সময় অসুরগণ দেবতাদের স্বর্গ থেকে উৎখাত করে এবং মহিষাসুর তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান শক্তি হয়ে ওঠে। অসুরদের উৎখাত করতে দেবতারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের কাছে সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করেন। তখন দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি থেকে সৃষ্টি হয় দেবী দুর্গা। তার উত্থান হয় সকল দেবতাদের সম্মিলিত তেজ থেকে, যারা তাকে তাদের অস্ত্র ও ক্ষমতা প্রদান করে। দুর্গার হাত দশটি, প্রতিটি হাতে দেবতাদের দেয়া অস্ত্র রয়েছে। তার বাহন সিংহ, যা শক্তি ও সাহসের প্রতীক।
মহিষাসুর বধ
মহিষাসুর ব্রহ্মার কাছ থেকে বর পেয়ে স্বর্গ ও মর্ত্যলোক দখল করে ফেলে এবং দেবতাদের পরাজিত করে। দেবতাদের আর্তির কারণে দেবী দুর্গার সৃষ্টি হয় এবং তিনি দশভুজা রূপে মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধ চলতে থাকে দীর্ঘ সময়, এবং শেষে মহিষাসুর যখন মহিষের রূপ ধারণ করে, তখন দেবী দুর্গা তার ত্রিশূল দিয়ে তাকে হত্যা করেন। দেবী দুর্গার এই বিজয়কে মহিষাসুরমর্দিনী বলা হয়, অর্থাৎ মহিষাসুরের বিনাশক। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই দুর্গা পূজার উৎসব পালিত হয়।
দেবী দুর্গার নবরূপ
দেবী দুর্গার নয়টি রূপ রয়েছে, যাকে নবরূপা বলা হয়। এই নয়টি রূপ হল: ১. শৈলপুত্রী: পার্বতী দেবীর প্রথম রূপ, শৈলরাজ হিমালয়ের কন্যা। ২. ব্রহ্মচারিণী: কঠোর তপস্যা করে মহাদেবকে অর্জন করেন। ৩. চন্দ্রঘণ্টা: তার কপালে অর্ধচন্দ্র আছে। ৪. কুষ্মাণ্ডা: বিশ্ব সৃষ্টির শুরুতে তিনি ছিলেন একমাত্র অস্তিত্ব। ৫. স্কন্দমাতা: কার্তিকেয়র মা। ৬. কাত্যায়নী: ঋষি কাত্যায়নের ঘরে জন্ম নেন। ৭. কালরাত্রি: অসুরদের বিনাশকালে তার রুদ্ররূপ। ৮. মহাগৌরী: সমস্ত পাপ ধ্বংসকারী এবং সৃষ্টির রক্ষাকারী। ৯. সিদ্ধিদাত্রী: সমস্ত সাফল্য ও সিদ্ধির দাতা।
দেবীর অন্যান্য রূপ ও দায়িত্ব
দেবী দুর্গা শুধু অসুর দমনের জন্যই নয়, তিনি সৃষ্টির, স্থিতির এবং ধ্বংসের রক্ষাকর্ত্রীও। তিনি শাকম্ভরী রূপে সারা পৃথিবীর খাদ্যের উৎস হিসেবে পূজিত হন, লক্ষ্মীরূপে ধন-সম্পত্তির অধিষ্ঠাত্রী এবং সরস্বতীরূপে বিদ্যার দেবী। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন রূপে তিনি ভক্তদের উদ্ধার করেছেন।
দুর্গাপূজা ও দেবীর আগমনের তাৎপর্য
দুর্গাপূজা বাংলার অন্যতম প্রধান উৎসব। আশ্বিন মাসে (অক্টোবর) দুর্গাপূজা পালিত হয়। পূজার সময়ে দেবী দুর্গা স্বর্গ থেকে মর্ত্যলোকে আসেন। তার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আনন্দের উৎসব শুরু হয়, এবং বিজয়াদশমীর দিন তিনি মহিষাসুরকে বধ করেন। দেবীর আগমন ও বিসর্জনকে কেন্দ্র করে প্রকৃতির পরিবর্তনও অনুভূত হয়।
দেবীর বার্তা:
দেবী দুর্গা অশুভের বিনাশ এবং শুদ্ধতার প্রতীক। তার কাহিনী মানব সমাজে ন্যায়, সততা এবং ধর্মের আদর্শের প্রয়োজনীয়তাকে নির্দেশ করে। দেবী দুর্গার লড়াই আমাদের শেখায় যে, অন্যায় যত বড়োই হোক না কেনো, ন্যায় এবং সচ্চরিত্র সবসময় জয়ী হবে।
দুষ্টের দমন
দেবী দুর্গা প্রধানত অন্যায় ও অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটাতে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। মহিষাসুরের মতো অসুরদের দমন করাই তার প্রধান কাজ। মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে হত্যা করেন এবং সৃষ্টিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন।
ধর্ম ও সৃষ্টির পালন
শুধু দুষ্টের দমনই নয়, দেবী দুর্গা সৃষ্টির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এবং সৃষ্টিকে সুস্থিত রাখতে পৃথিবীতে আগমন করেন। তিনি শস্য ও জীবনের প্রতীক হিসেবেও পূজিত হন। তার আশীর্বাদে প্রকৃতি ও প্রাণীকুলের কল্যাণ সাধিত হয়।
দেবী দুর্গা শুধু এক মহাশক্তি নন, তিনি মানবতার আশা এবং বিশ্বাসের প্রতীক। তার কাহিনী আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, দুষ্টের বিনাশ এবং সৃষ্টির রক্ষা করা ঈশ্বরের চিরন্তন দায়িত্ব।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট