তিন ধরনের পণ্য নিয়ে শুরু হচ্ছে সবার জন্য পেনশন ব্যবস্থা। এই পণ্যগুলো হলো বেসরকারি খাতের চাকরিজীবী, প্রবাসী বাংলাদেশি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মী। আগামী আগস্ট মাসেই মাঠে গড়াবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাটি। এরই মধ্যে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও একজন সদস্য নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। গত ৩ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক দাপ্তরিক আদেশে অর্থ বিভাগের বাজেট ও ব্যয় ব্যবস্থাপনা শাখার অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইজদানী খানকে চেয়ারম্যান ও প্রবিধি, বাস্তবায়ন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান শাখার অতিরিক্ত সচিব মো. গোলাম মোস্তফাকে সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত নিজ নিজ কাজের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালন করবেন। এখন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালনে আইন অনুযায়ী তৈরি করা বিধিমালা চূড়ান্তের গেজেট জারি অপেক্ষা মাত্র।
এদিকে সবার জন্য পেনশন ব্যবস্থার শুরুতে এর কোনো ধরনের মডেল পাইলটিং কিংবা কোনো এলাকার ভেতর সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে না। বরং সারা দেশে একযোগে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হবে।
তারা জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে ছয় স্তরের পরিকল্পনা ধরে কাজ চলছিল। পরে সেটি চার স্তরে নামিয়ে আনা হয়। তবে পেনশন ব্যবস্থাটি প্রাথমিকভাবে চালু হবে তিন স্তরের পরিকল্পনা ধরে বা তিন ধরনের পণ্য নিয়ে। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট কেটে গেলে পরে এ ব্যবস্থায় অসচ্ছল ব্যক্তিদের নিয়ে আরও একটি স্কিম চালুর পরিকল্পনা আছে। কারণ, এই স্কিমে পেনশন প্রত্যাশীদের চাঁদার অর্ধেক সরকার নিজে বহন করবে। কিন্তু বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় এ পণ্যটি আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে চালু করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে উদ্বোধনের দিন প্রতিটি পেনশন স্কিমে দেশের আট বিভাগ থেকে কমপক্ষে আটজন মনোনীত প্রতিনিধিকে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের (ইউপিএ) নির্ধারিত ওয়েবসাইটে নাম নিবন্ধন করানো হবে। সে হিসেবে তিন পণ্য বা স্কিমে ২৪ জন পেনশন সুবিধাপ্রত্যাশী নির্বাচিত করা হবে, যা জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনাররা সমন্বয় করে তা মনোনীত করবেন। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি প্রোডাক্ট স্কিম হবে স্বতন্ত্র। সব প্রোডাক্টেই একটি ন্যূনতম চাঁদার হার নির্ধারিত থাকবে। কেউ চাইলে বেশিও জমা করতে পারবে। কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত তহবিলে সংশ্লিষ্ট প্রোডাক্ট স্কিমের হিসাবে যার যত বেশি চাঁদা জমা পড়বে, তার আর্থিক সুবিধা পাওয়ার হারও তত বেশি হবে। ২০২০ সালে দেশে ষাটোর্ধ্ব জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ। এই সংখ্যা ২০৪১ সালে ৩ কোটি ১০ লাখ হবে বলে অনুমান করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে ধীরে ধীরে দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাঠামো না থাকায় বৃদ্ধকালে তাদের জীবনযাপনে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা আছে। ওই সময় তাদের স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপনে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতেই বর্তমান সরকার সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এ সম্পর্কিত কর্তৃপক্ষ গঠনের দাপ্তরিক আদেশ জারি হয়েছে। জানা গেছে, গণচীন তার সব নাগরিককে পেনশন সুবিধা দিতে বর্তমানে ৩ ধরনের এবং ভারতে ৭ ধরনের প্রোডাক্ট স্কিম চালু রেখেছে। দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট ও জনগোষ্ঠী আমলে নিয়ে ৩-৪ পণ্য নিয়েই পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে।
সূত্র মতে, বেসরকারি চাকরিজীবী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নাগরিকদের জন্য সর্বজনীন পেনশনের চাঁদার হার জনপ্রতি মাসিক সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য মাসিক চাঁদার সর্বনিম্ন হার ৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৭ হাজার ৫০০ টাকা এবং ১০ হাজার টাকার দুটি স্কিমও থাকবে প্রবাসীদের জন্য। তবে প্রবাসীদের বিদেশি মুদ্রায় এই চাঁদা দিতে হবে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় যুক্ত হলে ২.৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা পাবেন তারা। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী যদি ৫ হাজার টাকার স্কিমে যোগ দেন, তাহলে তার প্রকৃত চাঁদা হবে ৪ হাজার ৮৭৫ টাকা।
এ ছাড়া অসচ্ছল হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তির জন্য মাসিক চাঁদার হার নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার টাকা। এর মধ্যে অসচ্ছলদের জমা দিতে হবে ৫০০ টাকা, বাকি ৫০০ টাকা সরকার থেকে ভর্তুকি দেওয়া হবে। বিদ্যমান আইনের আওতায় ১৮ বছর বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সী সব বাংলাদেশি নাগরিক সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় যুক্ত হতে পারবেন এবং ৬০ বছর বয়স থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন। তবে ৫০ বছরের অধিক বয়সীরাও সর্বজনীন পেনশন সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। তবে অন্যদের মতো ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশন সুবিধা পাবেন না তারা। ১০ বছর চাঁদা পরিশোধের পর তারাও আজীবন পেনশন পাওয়া শুরু করবেন। অর্থাৎ কেউ ৬০ বছর বয়সে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হলে তিনি ১০ বছর চাঁদা পরিশোধের পর ৭০ বছর বয়স থেকে পেনশন সুবিধা পাবেন।অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, যারা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে চান, তাদের অবশ্যই নিবন্ধন করতে হবে। ঘরে বসে সবাই যাতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন, সেজন্য একটি অ্যাপ থাকবে। এ ছাড়া ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়েও নিবন্ধন করা যাবে। প্রবাসীরা বিদেশ থেকে অ্যাপ ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন। রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলে প্রত্যেকে একটি ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন নম্বর পাবেন। সেটাই তাদের পেনশন সুবিধাভোগীর পরিচিতি দেবে। সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলবে। অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে তার নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্ট নম্বরে মাসিক চাঁদা দিতে হবে। প্রবাসীরা বিদেশ থেকে চাঁদা দিতে পারবেন। আর নিবাসীরা সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কিংবা বিকাশ, নগদসহ যে কোনো মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতার (এমএফএস) মাধ্যমে ওই অ্যাকাউন্টে চাঁদা দিতে পারবেন। জনগণের ব্যাপক অন্তর্ভুক্তিকে উৎসাহিত করতে দেশব্যাপী সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার প্রচারণা চালানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। এর আওতায় টেলিভিশনে এবং অন্যান্য গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে পেনশন ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি থাকায় আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘সবার জন্য পেনশন’ সুবিধা চালুর বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।