কাঁচা মরিচ। দেখতে অনেকটা ছোট আকৃতির হলেও রান্নার জন্য এটি অপরিহার্য এক উপাদান। নিত্যদিনের চাহিদায় থাকা এই পণ্যের ঝালে অস্থির চারপাশ। প্রতিদিনই ভাঙছে দামের রেকর্ড; আর নিয়ন্ত্রণহীন দামে নাস্তানাবুদ সাধারণ মানুষ।
এক কেজি মরিচের জন্য এখন গুনতে হচ্ছে ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্তও। কিন্তু মরিচের এমন দাম নিকট অতীতে কেউ কখনো দেখেনি। স্বাভাবিক সময়ে ৬০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ। বৃষ্টির এই মৌসুমে কোনো কোনো সময় হয় ২০০ টাকা কেজি। কিন্তু এবার ভেঙেছে দামের সব রেকর্ড। দামের এমন ঊর্ধ্বগতি কেন, তা খতিয়ে দেখছে না কেউ। সোমবার (৩ জুলাই) দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মৌসুমী ইসলাম ও ফারহান ফেরদৌস।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায় ঢাকায় প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা। অলিগলির ছোট বাজারে দাম এর চেয়েও কিছুটা বেশি। তবে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকায় দাম আরও বেশি। সিলেট, পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন এলাকায় হাজার টাকা ছাড়িয়েছে দাম। ভারত থেকে আসছে কাঁচা মরিচ।
কাঁচা মরিচের দামের পর এখন বাড়তে শুরু করেছে শুকনা মরিচের দামও। প্যাকেটজাত ও খোলা- সব ধরনের শুকনা মরিচের দামই এখন চড়া।
প্রশ্ন হচ্ছে, কাঁচা মরিচের এমন আগুন দামের নেপথ্যে কে? বৃষ্টি, উৎপাদন কমের কারণে ঘাটতি, নাকি বাজার সিন্ডিকেট?
ক্ষুব্ধ ক্রেতা
২৮ বছরের জীবনে কাঁচা মরিচের এমন দাম দেখেননি মোহাম্মদপুর বাজারে আসা ইফতেখার। বলেন, ১০০ টাকার মরিচ চাইলেই দোকানি গুরুত্ব দেয় না। যাও পাওয়া যায়, তা দিয়ে দুই দিনও রান্না করে খাওয়া সম্ভব না। সরকারি চাকরিজীবী আব্দুল আলিমও সবজি কিনতে এসে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। বলেন, মরিচের এমন দাম কি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব ছিল না?
শেওড়াপাড়া বাজারে ঈদের পর গিয়ে মরিচের দাম শুনে হতবাক ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম। বলেন, ঈদের আগে মরিচের কেজি ছিল ৪০০ টাকা। তখন অল্প করে কিনে ঈদটা সামাল দেয়া হয়েছে। ঈদের পর দাম কমবে এই আশায় বেশি করে করে কেনা হয়নি। এখন দেখি তার চেয়েও দ্বিগুণ হয়েছে দাম। শিক্ষার্থী আনিছুর রহমান জানান, মরিচ যেহেতু প্রতিদিনের চাহিদায় থাকা পণ্য, তাই এত দাম হলে সংসারের খরচও বেড়ে যায়। মাস শেষে ব্যয়ে টান পড়ে।
শেওড়াপাড়া বাজার থেকে আড়াই শ গ্রাম মরিচ ১৭০ টাকা দিয়ে কিনে ক্ষুব্ধ একজন ক্রেতা বলেন, দেখার যেন কেউ নেই। ক্রেতারা জানান, বাজারে তদারকি নেই। দাম কেন বাড়ছে, তার একটা যৌক্তিক কারণ থাকা দরকার। কিন্তু সেই কারণ খুঁজে বের করার কেউ নেই।
সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট
দামের এমন উল্লম্ফনের পেছনে কে? বৃষ্টি, উৎপাদন কম, নাকি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট! প্রতিবছরই বৃষ্টির মৌসুমে কাঁচা মরিচের উৎপাদন কমে যায়। কারণ মরিচগাছের নিচে পানি উঠলে আর বাঁচানো যায় না। তাই ওই সময়ে সরবরাহ ঘাটতির কারণে দাম কিছুটা বাড়ে।
কিন্তু এমন বৃদ্ধি অকল্পনীয়। স্বাভাবিক দামের চেয়ে কেজিতে ১০০ টাকা বেশি হলেও এবার বেড়েছে অন্তত ৮ থেকে ১০ গুণ। বলা হচ্ছে হঠাৎ করে কাঁচা মরিচের চাহিদাও তেমন বাড়েনি। ঈদের জন্য কিছুটা বাড়লেও তা সহনীয়। ঈদের ১০-১২ দিন আগ থেকেই বাড়ছে দাম।
সংশ্লিষ্টদের মত, সংকটকে পুঁজি করে একশ্রেণির অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ী বাড়িয়ে দিয়েছে দাম। প্রথমে পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ে। পরে খুচরা পর্যায়ে বাড়িয়ে দেয়া হয় ইচ্ছামতো। পাইকারি পর্যায়ে যখন দামের ক্ষেত্রে ওঠানামা করে, তখন খুচরা পর্যায়ে সুযোগ নেয়া হয়।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাজারে ১ জুন প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হয় ৬০০ টাকায়। কিন্তু গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দেয়ার পর ৫০ টাকা কমিয়ে বলা হয় ৫৫০ টাকা। কেন দাম কমানো গেল? বা বেশি কেন চাইলেন জানতে চাইলে দোকানি বলেন, ক্রেতারা দরদাম করে টাকা দেয়। ওই দোকানি বলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এখানে কম আছে।
পাইকারি পর্যায় থেকে যত দামেই কেনা থাকুক, হুজুগে দাম বাড়িয়ে ক্রেতার পকেট কাটে অতিমুনাফালোভী একশ্রেণির ব্যবসায়ী। কত শতাংশ লাভে পণ্য বিক্রি করা যাবে তার কোনো নিয়ম না থাকায় ইচ্ছামতো দামে বিক্রি করা হয় পণ্য।
রাজধানীর অন্তত পাঁচটি বাজারে কাঁচা মরিচের দাম নিয়ে খোঁজ নিলে একেক বাজারে একক দাম পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন সংকটকে পুঁজি করে সুযোগ নিচ্ছে সবাই।
উৎপাদন কত
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে সারা দেশে ৪ লাখ ৭০০ একর জমিতে মরিচ আবাদ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ৩ লাখ ৭ হাজার ১২১ হেক্টর জমিতে। ৯১ শতাংশের বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে মরিচ। আর এ পর্যন্ত গ্রীষ্মকালীন উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৪৪৬ মেট্রিক টন কাঁচা মরিচ।
মরিচের চাষ বাংলাদেশের সব জেলাতেই হয়। তবে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় বগুড়া, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নাটোর ও যশোর জেলায়। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের বাইরে আনাচে-কানাচে নিজেদের খাওয়া বা ব্যবহারের জন্যও উৎপাদন হয় মরিচ।
দেশে মরিচ সাধারণত শীত ও গ্রীষ্মকাল উভয় মৌসুমেই উৎপাদিত হয়। প্লাবন ও অতিবৃষ্টি মরিচ উৎপাদনের জন্য প্রতিকূল। মরিচের শীতকালীন উৎপাদন গ্রীষ্মকালীন উৎপাদন থেকে বেশি। মরিচগাছ রোপণের সময় থেকে তিন মাসের মাথায় গাছ থেকে মরিচ পাওয়া যায়। পাঁচ মাসের মাথায় কাঁচা মরিচ পাকে। পরের ১৫ দিন থেকে এক মাসে পাকা মরিচ রোদে দিয়ে শুকানো হয়।
কাঁচা মরিচের পথে শুকনা মরিচও
বাংলাদেশের অন্যতম গুঁড়া মসলার ব্র্যান্ড স্কয়ার গ্রুপের রাঁধুনী। রাঁধুনী মরিচের গুঁড়া বিক্রি করে ২৫ গ্রাম, ৫০ গ্রাম, ১০০ গ্রাম, ২০০ গ্রাম, ৪০০ গ্রাম, ৫০০ গ্রাম ও ১০০০ গ্রাম। এক মাসের ব্যবধানে ৫০ গ্রাম রাঁধুনী মরিচের গুঁড়ার দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ।
দোকানে গিয়ে দেখা যাচ্ছে চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল প্যাকেট করা রাঁধুনী ৫০ গ্রাম মরিচ গুঁড়ার দাম ছিল ৪০ টাকা। ঠিক এক মাস পর ১৩ মে প্যাকেট করা রাঁধুনী ৫০ গ্রাম মরিচের গুঁড়ার দাম হয়েছে ৪৮ টাকা। বর্তমানে গুঁড়া মরিচ ৪৮ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ৫০ গ্রাম প্যাকেটের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ।
এ বিষয়ে তেজগাঁও বাবলি মসজিদের পাশেই এক দোকানদার বলেন, ‘পাইকারিতে তারা খুব দ্রুত দাম বাড়াচ্ছে। এতে আমাদের সঙ্গে ক্রেতাদের সমস্যা হচ্ছে। কিনতে এসে বাকবিতণ্ডা করছে। এগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।’
দেশের বড় অনলাইন মুদির বাজার চালডালে গতকাল রাঁধুনী ব্র্যান্ডের ২০০ গ্রাম মরিচের গুঁড়ার দাম চাওয়া হচ্ছে ১৭০ টাকা। ১০০ গ্রামের দাম ৯০ টাকা আর ৫০০ গ্রামের দাম ধরা হয়েছে ৪১০ টাকা। এক কেজি রাঁধুনী মরিচের গুঁড়ার দাম চাওয়া হচ্ছে ৭৮০ টাকা।
কারওয়ান বাজারের দোকানি মো. সেলিম বলেন, এক মাস আগেও এক কেজি রাঁধুনী মরিচের গুঁড়ার দাম ছিল ৬০০ টাকার বেশি, এখন সেই রাঁধুনী মরিচের গুঁড়ার দাম হয়েছে ৭০০ টাকার বেশি।
রাঁধুনী ছাড়া অন্যান্য ব্র্যান্ড যেমন প্রাণ অথবা মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ গুঁড়া মসলার একই দাম বাংলাদেশের বাজারে।
সুপারশপ স্বপ্নে দেখা গেছে, স্বপ্ন ২০০ গ্রাম মরিচের গুঁড়া বোতলেরটি ১৭০ টাকা, যেটি রাঁধুনীর সমান। প্রাণের ২০০ গ্রামের দাম ১৭০ টাকা আবার মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ব্র্যান্ডের ২০০ গ্রাম মরিচের গুঁড়ার দামও ১৭০ টাকা।
ভারতে বাংলাদেশের তুলনায় মরিচের গুঁড়ার দাম কম। ভারতের অনলাইন শপ স্টার কুইকে গিয়ে দেখা যাচ্ছে স্টার ব্র্যান্ডের ৫০০ গ্রাম মরিচের গুঁড়ার দাম চাওয়া হচ্ছে ২৩৫ টাকা। আর ভারতে রামদেব ব্র্যান্ডের ৫০০ গ্রাম মরিচের গুঁড়ার দাম চাওয়া হচ্ছে ৩৩০ টাকা।
পাকিস্তানেও বাংলাদেশের তুলনায় মরিচের গুঁড়ার দাম কম। পাকিস্তানে অনলাইন শপ দারাজে কাশ্মীর ব্র্যান্ডের ৫০০ গ্রাম মরিচের গুঁড়ার দাম চাওয়া হচ্ছে ২২৭ টাকা।
তদারকি নেই
কাঁচা মরিচের এই নৈরাজ্যকর দামে বাজারে কোনো তদারকি নেই। গত কয়েক দিনে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে তদারকির ক্ষেত্রে মাঠে দেখা যায়নি।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি মন্ত্রণালয়ের কোনো মনিটরিং টিম কারণ খুঁজতে বাজারে নামেনি। ফলে ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে কাটা হয়েছে ক্রেতার পকেট। ঈদের আগের কদিন এবং পরের তিন দিন কোনো বাজার মনিটরিং ছিল না।
সরকারের দু-একজন মন্ত্রী এ বিষয়ে কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে উৎপাদন কম এবং বৃষ্টি ঘাড়েই দায় চাপানো হয়েছে। সিন্ডিকেট আছে কি না তাও খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘একসময় পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, আটা, ময়দা নিয়ে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করছে। এখন যারা মরিচ ব্যবসায়ী তারা বলছে আমরা কেন বসে থাকব? সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। সরকার থেকে বলা হয়েছে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে অস্থিরতা বেড়ে যাবে। ফলে ব্যবসায়ীরা বুঝে গেছে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না। কারসাজি করে সবাই পার পেয়ে যাচ্ছে বলেই দাম বাড়িয়ে ক্রেতার পকেট কাটার একটা প্রতিযোগিতায় নেমেছে সবাই। কারণ এসব তদারকির দায়িত্বে যারা আছে তাদের কোনো তৎপরতা নেই। ফলে ভোক্তার মাশুল গুনতে হচ্ছে।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাহনাজ সুলতানা বলেন, ‘বাজার তদারকি আরও জোরদার করা হচ্ছে। দাম নৈরাজ্যের বিষয়ে শিগগিরই পদক্ষেপ শুরু হবে।’