আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী কবি, কথা সাহিত্যিক, অসামান্য গল্পের স্রষ্টা কবি আল মাহমুদের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। কবি ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি মারা যান। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জুলাই ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মোড়াইল গ্রামে কবির জন্ম।
তার প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তার পিতার নাম মীর আবদুর রব ও মাতার নাম রওশন আরা মীর। তার দাদা আব্দুল ওহাব মোল্লা হবিগঞ্জ জেলার বিখ্যাত জমিদার ছিলেন।
বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে তিনি এক প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিভা। আধুনিক বাংলা কবিতার নগরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহ তাঁর কবিতার বিশেষ উপাদান। তাঁর কবিভাষা লোকজ জীবনকেন্দ্রিক। কথাসাহিত্যেও রয়েছে তাঁর অসামান্য অবদান। সাহিত্যচর্চার প্রথম দিকে সমাজতন্ত্রের প্রতি ভীষণভাবে আস্থাশীল ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে প্রকাশিত সরকারবিরোধী একমাত্র পত্রিকা দৈনিক গণকণ্ঠ-এর সম্পাদক হিসেবে তিনি সুপরিচিত।
আল মাহমুদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পাকিস্তান-আন্দোলন, ভারত উপমহাদেশের বিভাজন এবং নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের ভাষা-আন্দোলনের প্রবল প্রবাহের সময়ে শৈশব-কৈশোর অতিক্রম করেছেন। নতুন দেশের জন্য অফুরন্ত আশা আর আশাভঙ্গের দারুণ হতাশার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন তিনি। শৈশবে পারিবারিক ইসলামি ঐতিহ্যে লালিত হয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাগরিক ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আবহ, বিশেষ করে, লালমোহন পাঠাগারকেন্দ্রিক বামচিন্তাধারা ও বৈপ্লবিক চেতনা এবং জগতপুরের স্কুলজীবনে নির্মল প্রকৃতির প্রভাব তাঁর কল্পনা ভুবনে সৃজনশীলতার বীজ বপন করেন। যৌবনের শুরুতে দেখেছেন স্বাধিকারের স্বপ্ন-ঘেরা এটি জাতির প্রস্তুতিকাল।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে দাদি বেগম হাসিনা বানু মীরের কাছে বর্ণপাঠ দিয়ে শিক্ষাজীবন শুরু। তাঁর কাছ থেকেই বিশাল বৈচিত্র্যময় আকাশের বিস্তার অবলোকনের প্রথম পাঠ গ্রহণ। ওই সময়ে মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছ থেকে গ্রহণ করেন ধর্মীয় শিক্ষা। ১৯৪৩-৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এম. ই স্কুলে ২য় থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ৬ষ্ঠ জর্জ হাইস্কুলে পড়েছেন ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত। ৮ম শ্রেণিতে পড়েছেন কুমিল্লার দাউদকান্দির জগতপুরে সাধনা হাইস্কুলে। তারপর তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ভাষা-আন্দোলনের সময় তিনি নিয়াজ মোহাম্মদ হাইস্কুলে ১০ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে কবি আল মাহমুদ দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৭-৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ড্রেজার ডিভিশনে গেজ রিডার পদে এবং লাইফবয় সাবানের সেলসম্যান হিসেবে চাকরি করেন।
১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রুফ রিডার পদে যোগ দেন। পরে তাঁকে জুনিয়র সাব এডিটর এবং মফস্বল সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে ইত্তেফাক প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসানের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়ে আর্ট প্রেসে প্রকাশনা তদারকির কাজ করেন এবং চট্টগ্রামের প্রখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা বইঘর-এর প্রকাশনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় ইত্তেফাক চালু হলে তিনি সহ-সম্পাদক পদে যোগ দেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইত্তেফাক কার্যালয় গুড়িয়ে দিলে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগের জুনিয়র স্টাফ অফিসার পদে যোগ দেন। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাসদ-এর মুখপত্র এবং সরকারবিরোধী একমাত্র পত্রিকা দৈনিক গণকণ্ঠ-এর সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন।
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে কারাবরণ করেন। প্রায় ১ বছর কারাভোগের পর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর প্রচেষ্টায় ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তি পান। কারামুক্তির কয়েকদিন পরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ লাভ করেন। কারাবাসের সময়ে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব পঠন-পাঠনের ফলে তাঁর চিন্তাজগতে পরিবর্তন ঘটে। নাস্তিকতার পথ থেকে আস্তিকতার দিকে ফিরে আসেন।
তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: কবিতা- লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না, বখতিয়ারের ঘোড়া, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, প্রহরান্তে পাশফেরা, একচক্ষু হরিণ, মিথ্যাবাদী রাখাল, আমি দূরগামী, হৃদয়পুর, দোয়েল ও দয়িতা, দ্বিতীয় ভাঙন, নদীর ভিতরে নদী, উড়ালকাব্য, না কোনো শূন্যতা মানি না, বিরামপুরের যাত্রী, তোমার জন্য দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী, দৈনিক কর্ণফুলী, সঙ্গীত সিরিজ-১ (গুল মোহাম্মদ খানা, কানাইলাল শীল, ফুলঝুরি খান) ইত্যাদি।
আল মাহমুদ ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ ও ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় কবিতা সম্মেলনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ও সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ থেকে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি জাতীয় নাগরিক ফোরামের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে কবি আল মাহমুদ তৃতীয় বিশ্বগ্রন্থমেলায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। আশির দশকে ভারতের ভূপালে এশীয় কবিতা সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি একাধিকবার ভারতের দিল্লি এবং কলকাতার আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
সাহিত্যচর্চার জন্য কবি ও কথা নির্মাতা আল মাহমুদ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বাংলা একাডেমি পুরস্কার, 'জয়বাংলা সাহিত্য' পুরস্কার, 'হুমায়ুন কবির স্মৃতি' পুরস্কার, 'জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি' পুরস্কার, সুফী মোতাহার হোসেন সাহিত্য' স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ লেখক সংঘ পুরস্কার, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার, 'শিশু একাডেমি (অগ্রণী ব্যাংক) পুরস্কার, আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, নতুনগতি সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় মঙ্গলপদক, ঢাকা পোস্ট স্বর্ণপদক, শিশু একাডেমি পুরস্কার প্রভৃতি।