ভাষার প্রবাহের সৌন্দর্য প্রাকৃতিক অনেক অপার সৌন্দর্যের একটি বিমূর্ত রূপ। হাইওয়েতে যখন গাড়ি দ্রুত চলে একটি অঞ্চল থেকে আরেকটি অঞ্চলে প্রবেশ করতে করতে সেখানকার জীবনযাত্রার চিত্রের পরিবর্তনটা লক্ষ করা যায়। তবে সেই পরিবর্তিত জীবনধারা একেবারে যে শতভাগ পরিবর্তিত হয়ে যায় তা না। পূর্ববর্তী এলাকার কিছু বৈশিষ্ট্যও পরবর্তী এলাকায় দেখা মিলে। ভাষার প্রবাহটাও অনেকটা এমন। ভাষাকে বহন করে মানুষ। মানুষের ঠোঁটে চড়ে এক অঞ্চল থেকে ভাষা আরেক অঞ্চলে যায়। যেতে যেতে সেটা মাঝেমাঝে অন্য ভাষার সঙ্গে মিশে যায় এবং চড়ে আসা ভাষাটিই হয়ে ওঠে সেই অঞ্চলের ভাষা।
ভাষা বৈচিত্র্যের এই দিকটি বেশ চোখে পড়ে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের মানুষের আঞ্চলিক ভাষা আরাকানের ভাষার সঙ্গে নব্বই ভাগ মিল। রোহিঙ্গাদের ভাষা বুঝতে বিদেশিদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে চট্টগ্রাম থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করা তরুণ-তরুণীরা।
চট্টগ্রামের স্থানীয় অধিবাসীরা কথা বলে এমন আরেকটি ভাষা যেটা নিয়ে এখন পর্যন্ত খুব বেশি পরিমাণে আলোচনা হয়নি। সেটি হলো খোট্টা ভাষা। খোট্টা ভাষা হলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা। খোট্টা ভাষা হলো হিন্দি-উর্দু বা হিন্দুস্তানি ভাষার একটি বিবর্তিত আঞ্চলিক রূপ। ভারতে এই ভাষাটির মূল হলেও ভারতের বাইরে এই ভাষাটির দেখা মিলে চট্টগ্রামের আনোয়ারার উত্তর বন্দর এলাকায়। চট্টগ্রামের সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠা, চট্টগ্রামের মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা থাকলেও খোট্টা সম্প্রদায়ের ভাষা চট্টগ্রামের মানুষদের থেকে একেবারেই ভিন্ন। খুব কাছাকাছি এলাকার মানুষ না হলে চট্টগ্রামের অন্য এলাকার মানুষও এই ভাষা বুঝবে না। শুরুতেই মানুষে ধরে নিবে এরা হয়ত ভারতীয় আর মনে করবে এরা হিন্দি ভাষায় কথা বলছে।
বন্দর এলাকায় খোট্টা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এদের বেশিরভাগই মুসলিম। কিছু হিন্দু পরিবারও আছে অবশ্য। দীর্ঘ সময় ধরে এদের জীবনযাত্রার মান নিম্ম পর্যায়ে ছিলো। ভাষাগত পার্থক্য এবং ভিন্ন জাত হওয়ার কারণে এরা সমাজে অনগ্রসর ছিলো। এখন অবশ্য খোট্টা ভাষাভাষীদের অনেকেই ভালো অবস্থানে আছেন। শিক্ষার মানও বেড়েছে। খোট্টা ভাষাভাষীদের বিরাট একটি অংশ চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের নিকটস্থ ১৫ নম্বর ঘাটের নৌকা পারাপারের কাজ করে।
খোট্টার ভাষার মূল ভারতে হলেও এর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভাষাভাষী চট্টগ্রামে কীভাবে এলো সেটা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মিশ্র মতামত রয়েছে। তবে অভিন্ন মত হচ্ছে অখণ্ড ভারতবর্ষ থাকাকালীন পশ্চিমবঙ্গ থেকে এই ভাষা চট্টগ্রামে এসেছে। একটি মতামতে বলা হয় পর্তুগিজ মাধ্যম হয়ে এই ভাষা এখানে এসেছে, তবে খোট্টা ভাষাভাষীদের বেশীরভাগ মুসলিম হবার কারণে সেই মতামত এর গ্রহণযোগ্যতা কম। অন্য একটি প্রসিদ্ধ মতামত হলো, ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে শাহ সুজা আওরঙ্গজেবের পরাজয়ের কারণে তার কিছু সৈন্য বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়েন। সৈন্যদের একটি অংশ আনোয়ারার বন্দর এলাকায় থেকে যান। পরবর্তীকালে এখানে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম গড়ে ওঠে।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন সর্বপ্রথম ভারতীয় উপভাষা সম্পর্কে যে গবেষণামূলক অনুসন্ধান করেন, তাতেও ‘খোট্টা’-র বিষয়টি উঠে আসে। তার 'Linguistic Survey Of India’ তে এ সম্পর্কে আলোকপাত আছে। তিনি লেখেন ‘On the western boundary of this dialect (Eastern Magahi) there are various mixed dialects which are generally known as ‘Khotta’ or impure Bengali. It is often difficult to say whether these should be classed as a dialect of Bengali, or of the neighbouring Bihari.’
ভারতে খোট্টা ভাষাভাষীদের স্বতন্ত্র কিছু সংস্কৃতি থাকলেও চট্টগ্রামে বসবাসরত এ ভাষাভাষীরা বাংলাদেশের সংস্কৃতিতেই তাদের জীবনযাপন অতিবাহিত করছেন। যদিও তাদের মুখে খোট্টা ভাষাটি এখনো বেঁচে আছে তবে তাদের পড়ালেখা, বাইরের মানুষের সঙ্গে দৈনন্দিন যোগাযোগ সব বিশুদ্ধ বাংলায় এবং চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষায় হয়।
এই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে তাদের মুরব্বী এবং শিক্ষিত শ্রেণির একটি অংশের মধ্যে তাড়না থাকলেও কেউ কেউ নিজেদের অবশ্য খোট্টা পরিচয় দিতে সংকোচবোধ করেন। এই ভাষা হারিয়ে যাবার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখেন কাজের জন্য অন্যত্র গিয়ে সেই ভাষায় অভ্যস্ত হওয়া।
খোট্টারা একটা সময়ে নিজেদের গোত্রের মধ্যেই বিয়ে করতো। বর্তমানে খোট্টার বাইরেও বিয়ে হওয়ার কারণেও এই ভাষা অনেকটা হারিয়ে যাচ্ছে।
খোট্টা ভাষা যে দেশের ভাষা বৈচিত্র্যের অন্যতম একটা সৌন্দর্য এটি খোদ খোট্টা ভাষাভাষীরাই খুব বেশি ধারণ করেন না। যে কারণে এরা তাদের ভাষা নিয়ে হীনমন্যতায় থাকেন। খোট্টা ভাষাকে সংরক্ষণের জন্য সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জরুরি। কারণ, ভাষার এই বৈচিত্র্য বেঁচে থাকলেই আমরা জানবো আমাদের ইতিহাস। এই ভাষাই আমাদেরকে আমাদের সভ্যতার কথা জানান দেবে।
জীবজগতের চারিত্রিক ধারা জিনের মধ্যে থাকে। আর ভাষাকে বলা যায় মানব সভ্যতার সাংস্কৃতিক জিন। একটি সম্প্রদায় বেঁচে থাকে ভাষার মাধ্যমে। যোগ্যতমের টিকে থাকার মতো ভাষাকেও লড়াই করতে হয় অন্য ভাষার সঙ্গে। এ লড়াইয়ের মাঝে শব্দ হারিয়ে যায়, মৃত্যু হয় একটি ভাষার। তবে হারিয়ে যাবার আগে যদি কিছু ভাষা সংরক্ষণ করা যায় তাহলে অন্তত আগামী প্রজন্ম জানবে তাদের শিকড়ের গল্প।
প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারী আসলে মানুষের মাঝে বাংলা ভাষার প্রতি ভক্তি প্রদর্শনের একটা তাড়না দেখা যায়। আমরা যদি বায়ান্ন’র চেতনা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখবো সেই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট শুধু বাংলা ভাষার প্রতি প্রেম না। এখানে মাতৃভাষা অবমূল্যায়িত হয়েছে বলেই আমরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলাম। বিশ্ববাসী মাতৃভাষার প্রতি এই অনুভূতিটাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই অনুভূতিটা অবমূল্যায়িত হওয়া প্রত্যেক ভাষাভাষীর কাছেই প্রায় একই। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষার প্রাধান্যে যখন কারোর মাতৃভাষা অবমূল্যায়িত হয় অথবা হারিয়ে যায় তখন তার অনুভূতিও প্রায় বায়ান্নর বাংলা ভাষাভাষীদের মতোই।
তাই আমাদের উচিত কারোর মাতৃভাষাকে হেয় না করা। ভাষাগত সকল বৈচিত্রকে সৌন্দর্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সেসব ভাষাকে আগলে রাখার দায়িত্ব নেয়া।
লেখক: প্রাবন্ধিক
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBEকরতে ক্লিক করুন।