আমলাতান্ত্রিক আদেশে দুদকের ক্ষমতা খর্ব, হয়রানিমূলক বদলির আশঙ্কা - দৈনিকশিক্ষা

আমলাতান্ত্রিক আদেশে দুদকের ক্ষমতা খর্ব, হয়রানিমূলক বদলির আশঙ্কা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি অফিস আদেশ নিয়ে অনুসন্ধান ও তদন্তকাজে সরাসরি সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে।

এই আদেশবলে একক সিদ্ধান্তে তদন্ত ও অনুসন্ধান কর্মকর্তাদের বদলি করা যাবে, যা আগে ছিল কমিশনের হাতে।

এখন উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের বদলির ক্ষমতা দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের হাত থেকে সরিয়ে সচিবের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এতে খর্ব হয়েছে কমিশনের ক্ষমতা।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-নতুন এই আদেশের মাধ্যমে অনুসন্ধান ও তদন্ত কর্মকর্তাদের ওপর আমলাদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এই আদেশকে ‘হাতিয়ার’ হিসাবে ব্যবহার করে অনুসন্ধান ও তদন্তকাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং কর্মকর্তাদের হয়রানিমূলক বদলির আশঙ্কা করা হচ্ছে। দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।

জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘দাপ্তরিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে কম সময়ে যাতে নিষ্পত্তি করা যায়, সে লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে ডেলিগেশন অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল পাওয়ার (প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ) বিষয়ক বিধিমালা আছে। দুর্নীতি দমন কমিশনে এটা ছিল না। এখন এটা চালু করা হয়েছে। এতে কোনো নেগেটিভ ইনটেনশন নেই।’ অনেকেই বলছেন এই আদেশের মাধ্যমে কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে এবং অনুসন্ধান ও তদন্ত কর্মকর্তারা চাপে থাকবেন, এটা ঠিক কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুদক আইনে কমিশন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এতে কোনো দ্বিমত নেই। আমি সচিব হিসাবে জোর করে কোনো ক্ষমতা নিইনি। কমিশন চেয়েছে বলেই এটা হয়েছে। আবার কমিশন চাইলে বাতিল করে দেবে। আগে যে কোনো সিদ্ধান্তের জন্য ফাইল ওপরে পাঠাতে হতো। নতুন আদেশের কারণে সেটা করতে হবে না। এতে কাজের গতি বাড়বে। নতুন এই আদেশের কারণে কারও কোনো ভয় বা আতঙ্কের কিছু নেই।’ 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘তদন্ত ও অনুসন্ধান কর্মকর্তাদের বদলির সিদ্ধান্ত আইনগতভাবে কমিশন নেবে। এখন এটা আমলাদের হাতে চলে এলো কি না-সেই প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক। এই আদেশ উদ্দেশ্যমূলকভাবে দেওয়া হয়েছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা যেতে পারে। যেহেতু প্রশাসন ও আমালাতন্ত্রের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা বেশি, সেহেতু তাদের রক্ষা করতে এই আদেশ জারি করা হলো কি না, তাও ভাবনার বিষয়। এমনিতেই দুদকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমলাদের হাতেই বেশি। নতুন এই আদেশে সেটা আরও বাড়তে পারে। আর দুদকে সরাসরি নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা বরাবরই বৈষম্যের শিকার। এবার সেটা প্রকাশ্যে এলো। এই আদেশ স্বাধীন তদন্তকাজে ঝুঁকির সৃষ্টি করবে।’

জানা যায়, ১৮ ডিসেম্বর দুদকের ডেলিগেশন অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল পাওয়ার (প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ) বিষয়ক একটি অফিস আদেশ জারি করা হয়। দুদক সচিবের স্বাক্ষরে জারি করা ওই আদেশের ‘গ’ অনুচ্ছেদে কমিশনের অনুসন্ধান ও তদন্তকাজের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তার বদলির ক্ষমতা কমিশনের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা তাদের কাজের পরিধি তুলে ধরে জানান, দুর্নীতি প্রতিরোধে একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুদক। দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনতে মামলা রুজু ও চার্জশিট দাখিলের জন্য কমিশনের কাছে সুপারিশ পেশ করেন কমিশন কর্তৃক নিযুক্ত অনুসন্ধান ও তদন্তকারীরা। দুদকে কর্মরত উপসহকারী পরিচালক থেকে উপপরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তারা অনুসন্ধান ও তদন্ত করে থাকেন। এছাড়া পরিচালক ও তার ওপরের কর্মকর্তারা তদারকি কাজ করেন। আর উপসহকারী পরিচালকের নিচের কর্মচারীরা ‘সাপোর্টিং স্টাফ’ হিসাবে কাজ করে থাকেন। অর্থাৎ অনুসন্ধান ও তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপসহকারী পরিচালক থেকে উপপরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তারাই দুদকের মূল চালিকাশক্তি। যাদের স্বাধীনভাবে কাজ করা উচিত। কিন্তু তারা কাজ করেন কমিশনের অধীনে। এরপরও তাদের নিয়ন্ত্রণ কমিশনের হাতে না রেখে একক ব্যক্তির হাতে ঠেলে দেওয়ার এই নতুন অফিস আদেশ প্রশ্নবিদ্ধ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রজাতন্ত্রের কাজে নিযুক্ত কর্মচারীদের ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ করে অর্থ আত্মসাৎ, ঘুস লেনদেন, সরকারি দায়িত্বে থেকে প্রতারণা ও জালিয়াতি, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা অনুসন্ধান ও তদন্ত করা দুদকের মূল কাজ। এসব অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত থাকে। বিশেষ করে প্রভাবশালী কর্মকর্তারাই এই কুকর্মে এগিয়ে। এদের অপরাধ উন্মোচনে দুদক কর্মকর্তারা এতদিন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে স্বাধীনভাবে কাজ করেছেন। কিন্তু ১৮ ডিসেম্বর (স্মারক নং ৪৬৫৩৩) জারি করা অফিস আদেশের মাধ্যমে সেই স্বাধীনতা আর থাকছে না। অনেকেই বলেছেন, তাদের এখন অনেকটা ‘নিজভূমে পরবাসী’ হয়ে কাজ করতে হবে।

দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কোনো অভিযোগের অনুসন্ধান ও মামলার তদন্ত কাকে দিয়ে করাবেন, তা কমিশন নির্ধারণ করে থাকে। অনুসন্ধান ও তদন্তকাজের সঙ্গে সংস্থার সচিবের বিন্দুমাত্র কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অথচ এই আদেশের বলে যখন যিনি সচিবের চেয়ারে থাকবেন, তিনি তার খেয়াল-খুশিমতো অনুসন্ধান ও তদন্ত কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাববিস্তার করতে পারবেন। তার কথা না শুনলে অথবা তার নির্দেশমতো কাজ না করলে অনুসন্ধান ও তদন্তকারীদের যেখানে খুশি সেখানে বদলির মাধ্যমে শায়েস্তা করতে পারবেন।

জানা যায়, ২০০৪ সালে কমিশন গঠনের সময় আইনের প্রস্তাবনাসহ একাধিক ধারায় ‘স্বাধীন’ কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করবে। কমিশনের অধীন তদন্তকারীরাও ডেলিগেটেড ক্ষমতা নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার চেতনাই উজ্জীবিত ছিল ২০০৪ সালের আইনে। কমিশনের সচিব কমিশন কর্তৃক নিযুক্ত হবেন মর্মে ১৬ ধারায় বলা থাকলেও দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সব ক্ষেত্রেই সচিব পদে আমলাদের নিয়োগ দিয়েছে সরকার। দুদক কর্মকর্তারা জানান, কমিশনের কমিশনাররা স্বাধীন হলেও রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক তদবিরে সরকার বিভিন্ন সময় পছন্দের লোকদের সচিব পদে নিয়োগ দেন। ফলে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না বা করেন না। প্রভাবশালী কোনো মহলের উদ্দেশ্যসাধনের জন্যই হয়তো তদন্তকারীদের চাপে রেখে কাজ করাতে তাদের বদলির ক্ষমতা কমিশনের হাত থেকে সরিয়ে সচিবের কাছে দেওয়া হয়েছে।

দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ভাষ্য, অনুসন্ধান ও তদন্তকারী কর্মকর্তারা এতদিন কমিশন প্রদত্ত ক্ষমতা স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করতে পারতেন। কারণ তারা জানতেন, অনৈতিক তদবির না শুনলে বা প্রভাবশালী অভিযুক্ত ব্যক্তি বা আমলার কথা না শুনলেও কমিশন তাদের রক্ষা করবে। কিন্তু নতুন অফিস আদেশের ফলে তদন্তকারী কর্মকর্তারা সব সময় বদলি আতঙ্ক নিয়ে তদন্ত করবে। দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বিদায় নেওয়ার সময় বলেছিলেন, দুদকে আন্তর্জাতিক মানের কর্মকর্তা রয়েছেন। দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তা থাকলেও অনৈতিক তদবির দুদকের কাজের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। সম্প্রতি দুদক কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাধ্যমে পরিচালিত এক গবেষণায়ও দেখা গেছে, দুদকের পারফরম্যান্স কম হওয়ার পেছনে দায়ী উচ্চমহলের তদবির, আমলা ও প্রভাবশালীদের অযাচিত হস্তক্ষেপ।

স্বাধীন তদন্ত নিশ্চিত করতে তদন্তকারীদের বদলির নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কমিশনের হাতে ফিরিয়ে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। একই সঙ্গে দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকের কাজে অনৈতিক তদবির বন্ধে প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পরমর্শও দিয়েছেন তারা।

৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও - dainik shiksha ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল - dainik shiksha বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক - dainik shiksha এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত - dainik shiksha জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003676176071167