দেশের বাইরে কান পাতলেই শোনা যায় বাঙালি একটি অসভ্য জাতি। আবার দেশের ভেতরেও অনেকেই রবিঠাকুরকে উদ্ধৃত করে বলেন ‘সাত কোটি মানুষের হে মুগ্ধ জননী/রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি।’ তার মানে, গুরুদেব স্বয়ং বাঙালিকে সভ্যমানুষ বলতে নারাজ ছিলেন। অবশ্য কয়েকটি উদাহরণই পরিষ্কার বলে দেবে আমরা সত্যিকার অর্থে কতোটুকু সভ্য ও শিক্ষিত হতে পেরেছি। যদিও বর্তমানে আমাদের শিক্ষার হার সরকারি হিসেব মতে খুবই সন্তোষজনক। তবে কি শিক্ষার সঙ্গে সভ্যতা হাত ধরাধরি করে সমানতালে চলছে না? জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে পৃথিবীতে আজ’--সে আঁধার কি এ দেশে এখন আরো ঘনীভূত? আমরা কি তবে শিক্ষা নয়, শুধু সার্টিফিকেট অর্জন করে চলেছি? আমাদের ঘাটতিটা কোথায়?
দুর্নীতিতে আমাদের অবস্থান কোথায় সেটি দেখার জন্য হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট খুঁজতে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। আমাদের ভূমি অফিস, জমি-রেজিস্ট্রি অফিস, পাসপোর্ট অফিস ইত্যাদিতে কাজ থাকলে (সরকারি অন্যান্য অফিসেও কমবেশি একই চিত্র) যেকোনো ব্যক্তি সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভ করবেন আমার মতোই। শিক্ষাদীক্ষায় তারা কেউ কারো চেয়ে কম নন, সরকার বাহাদুর তাদেরকে বেতনও সামান্যকিছু কম দেন না কিন্তু উপরি ঐটুকু না খেলে তাদের একেবারেই চলে না।
শিক্ষা মানুষের জীবনাচারণে শুদ্ধতা ও পবিত্রতা আনে, মানুষের মন থেকে অন্ধকার,পঙ্কিলতা দূর করে মানুষকে পরিচ্ছন্ন ও রুচিবান করে, মানবীয় গুণাবলির স্ফুরণ ঘটায়। দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতেই হবে অতি সামান্য দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাস্তবে সেটি ঘটছে না। বিগত দুই দশকে দেশে স্কুল-কলেজ সরকারিকরণ হয়েছে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ যদিও প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলার মান একটুও বাড়েনি, বাড়েনি সার্বিক শিক্ষার মান। বর্তমানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল এবং পিএইচডিধারীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ঘুষ, দুর্নীতি, খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, অযথা জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা এবং দুষ্কৃতকারীদের সিন্ডিকেটের সংখ্যা। খুব স্বাভাবিকভাবেই জনমনে প্রশ্ন উঠে, উচ্চশিক্ষা কি সুশাসন নিশ্চিতকরণে ব্যর্থ? নিশ্চয় কোথাও একটা গলদ তো রয়েছেই। বলা যেতে পারে, সুশিক্ষা নেই, তাই তথাকথিত শিক্ষিতজনের আচরণে পরিবর্তন নেই, তাই সুশাসনও নেই।
দীর্ঘদিন প্রবাসে বসবাসকারী কেউ ঢাকা বিমানবন্দরে নেমেই টের পান সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণ কেমন, যখন তিনি দেখেন তার ব্যাগে গচ্ছিত মালামালের পরিমাণ কমে গেছে বা আস্ত ব্যাগটিই উধাও হয়ে গেছে। প্রমাদ গুণে এবং মাথায় হাত দিয়ে তিনি হয়ত দীর্ঘশ্বাসে উচ্চারণ করেন, হে মাতবঙ্গ! ভান্ডারে তব বিবিধ রতন। সত্যিই এখানকার আদমসন্তানরা একেকজন বিবিধ রতন বটে! এবার শুরু হয় এই অত্যাধুনিক সিটির রাস্তা দিয়ে যাত্রা শুরু। রাস্তার দুপাশে রক্ষিত ময়লার স্তুপ থেকে উত্থিত সুবাস মস্তিস্কের নিউরনে সাড়া জাগায়, মাস্কের ওপর রুমাল চাপিয়েও রক্ষা নেই যদি যাত্রাটি হয় গাজীপুরের দিকে। এত নোংরা সিটি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয়না। যদিও সরকার কাঁড়িকাঁড়ি অর্থ ব্যয় করছেন এর উন্নয়নের পেছনে প্রতিবছর। এখানে বায়ুদূষণের মাত্রা ভয়াবহ আর এ দূষণ সম্পূর্ণ মনুষ্য-সৃষ্ট। এ শহরের প্রতিটি মোটরযানে লাগানো রয়েছে হাইড্রলিক হর্ণ যার অপব্যবহারে গাড়িচালকদের সামান্যতমও কার্পণ্য নেই। দীর্ঘ জ্যামে আটকা পড়ে থেকে তাদের কাজ একটাইকে কত লম্বা করে কানফাটানো হর্ণ বাজাতে পারে। আর যাত্রী মহোদয়দের অতি পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো গাড়ির ভেতরে বসে চিপস, বাদাম, বিস্কুট কলা, লিচু ফান্টা, কোক ইত্যাদি খেয়ে সেগুলোর খোসা এবং ক্যান গাড়ির জানালা দিয়ে রাস্তার ওপর নিক্ষেপ করা। এ শহরে রাস্তার দুপাশে কোথাও পাবলিক টয়লেট বা ভ্রাম্যমাণ ইউরিন্যাল নেই, অতএব যাত্রীদের ওই প্রাকৃতিক কর্মটির জন্য নির্ধারিত স্থান হলো ফুটভার ব্রিজের সিঁড়ির নিচের অংশটুকু। আবার সন্ধ্যার পর পথচারীরা ফুটভার ব্রিজের ওপরে উঠেও প্যান্টের জিপার খুলতে দ্বিধা বোধ করেন না।
২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের কোনো একদিন মালাক্কা প্রণালী দেখার সুযোগ ঘটেছিলো। তখন বলা হচ্ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা পানি প্রবাহিত হয় এই প্রণালী দিয়ে। সেখানকার ঘোলা জল দেখে আমার তা মনে হয়নি, বরং আমার দেশের তুরাগ এবং বুড়িগঙ্গার জল নোংরার দিক থেকে পৃথিবীসেরা। মাঝে মাঝে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে, ‘আমি তুরাগ এবং বুড়িগঙ্গা দেখেছি, তাই কৃষ্ণসাগর খুঁজিতে চাহি না আর’।
রাজধানীর পথচারীদের হাঁটার জন্য সরকার বাহাদুর ফুটপাত তৈরি করলেও কোনো ফুটপাত দিয়ে এখন আর হাঁটা যায় না, ওগুলো এখন হকার আর চা-বিড়িওয়ালাদের দখলে। ওরা অবশ্য বিনা পয়সায় ফুটপাথের দখল নেয়নি, ওদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তারা পুলিশ ও দলীয় মাস্তানদের নিয়মিত চাঁদা দিয়ে তবেই ফুটপাতে বসার সুযোগ পায়। আর বেচারা পথচারী! বিপুল জনতার ভিড় ঠেলে, নিজের পায়ের ওপর অন্যের পায়ের ঘা খেয়ে, হোঁচট-হুমড়ি খেয়ে, লাখো মানুষের হাঁচি-কাশির বন্যা গায়ে মেখে অসহায় পথচারীকে পথ চলতে হয়। কোভিড অতিমারির ঘা খাওয়ার পরও কারো সামান্যতম সচেতনতা জাগ্রত হয়নি অদ্যাবধি। উচ্চপদস্থ অনেকেরই রুচির বহর দেখলে অবাক হতে হয়, মনে হয় সত্যিই এদেশে রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে। স্যুট-টাই পরা কিছু ভদ্রলোককে দেখেছি, নাক ঝেড়ে প্যান্টে মুছতে মুছতে অফিসে ঢুকছেন যা দেখে পাশের জনের গা রিরি করে। বছর কয়েক আগে একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালার শেষে একটি ফরমাল নৈশভোজে এক সহকর্মীর পাশে বসে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলাম তা না বললেই নয়। ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত এই সহকর্মী শেষ বয়সে এসেও কোন হাতে কোন চামুচ ধরতে হয়, কীভাবে ধরতে হয় তা আয়ত্ব করতে না পারায় খাওয়ার শুরু থেকেই ওই ব্যবস্থা চালুর জন্য ইংরেজদের পিণ্ডি চটকান শুরু করলেন।
এক পর্যায়ে তিনি বললেন, হাঁচি পড়লে আলহামদুলিল্লাহ পড়তে হয়, আর পাশেরজনকে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলতে হয়- এটাই ইসলামি কায়দা। আমি এক্সকিউজ মি বলে উঠে গেলে ওয়েটার আমার পেছনে পেছনে এসে চুপিসারে আমার অনুমতি নিয়ে বললেন, স্যার, আমি সব লক্ষ্য করেছি। আপনার খাওয়া হয়নি স্যার ওনার কারণে, আপনি সারারাত ক্ষুধায় কষ্ট পাবেন, আমি তা হতে দেবো না। স্যার, আপনি আপনার রুমে যান, আমি সেখানে ফ্রেশ খাবার পৌঁছে দিচ্ছি। ওয়েটারের শিক্ষা না থাকলেও দীক্ষা আছে, দীর্ঘদিনের চাকরির অভিজ্ঞতায় তিনি অনেক কিছু শিখেছেন যা আমার সহকর্মী শেখেননি। টেবিল-ম্যানার, হাঁচি-কাশি আচার, খাবার টেবিলে বসে ক্রস-টকিং না করা, সামনাসামনি কথা বলার সময় শ্রোতার মুখ হতে নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রাখা যাতে মুখনিঃসৃত লালা-স্প্রে শ্রোতাকে আক্রান্ত না করে। প্রয়োজনীয় ধন্যবাদ জ্ঞাপন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, সিনিয়রদের সামনে পায়ের ওপর পা তুলে না বসা, মোবাইল ফোন সাইলেন্ট রাখা, অন্যের ফোনের স্ক্রিনের দিকে না তাকানো, ট্রেনে-বাসে অন্যের অসুবিধা সৃষ্টি করে নিজে পা ছড়িয়ে বসা, যিনি পেপার পড়ছেন তার পেপারের দিকে ঘাড় বাঁকা করে না তাকানো, অল্পপরিচয়ে মোবাইল নম্বর চাওয়া। বিশেষ করে মহিলাদের কাছে অনুমতি না নিয়ে অন্যের মোবাইল নম্বর আরেকজনকে দেয়া এসব সিলেবাসে থাকে না, বরং নিজের গরজে শিখে নিতে হয় যা শিক্ষারই একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সম্মানিত শিক্ষকদের উচিত সিলেবাসের বাইরে এসে ছাত্রদেরকে মাঝে মাঝেই এসব বিষয়ে টিপস বা ছবক দেয়া। অবশ্য শিক্ষক যদি আমার সেই সহকর্মীর মতোই হন তবে জাতির নিতান্তই দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে একবার দেখেছিলাম রিসেপশনিষ্ট সুন্দরি ভদ্রমহিলা যখন ওয়েলকাম করে হাত বাড়িয়ে দিলেন তখন আমার এক সিনিয়র সহকর্মী সে কোমল হাত আর সহজে ছাড়তে চাইছেন না, বেশখানিকটা কসরত করেই ভদ্রমহিলা সে হাত ছাড়িয়ে নিলেন এবং পরবর্তি সময়ে প্রশিক্ষণ চলাকালীন তাকে এড়িয়ে চলতে লাগলেন।
সব প্রতিষ্ঠানে ড্রেসকোড না থাকলেও চাকরিরতদের জন্য ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ আছে যা চাকরিতে যোগদানের সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী-কর্মকর্তাদেরকে প্রশিক্ষণ-কর্মশালার মাধ্যমে জানানো প্রয়োজন কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা করা হয় না। আবার প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হলেও প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়, প্রশিক্ষণার্থীরা শেখার চেয়ে চাইতে খাবারের মেন্যু, ব্যাগ, সুভেনির, টোকেন ইত্যাদির দিকেই নজর রাখেন বেশি। প্রশিক্ষণ শেষ করে তারা যখন নিজ নিজ চেয়ারে বসে কাজ শুরু করেন তখন দেখা যায় অধিকাংশ কর্মকর্তাই ম্যানার অ্যান্ড এটিকেট, ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস এবং অরগানাইজেশনাল বিহেভিয়ার সম্পর্কে কিছুই শেখেননি, তাদের ঘাটতির জায়গাটি সামান্যতমও পূরণ হয়নি অর্থাৎ প্রশিক্ষণ ব্যর্থ। প্রশিক্ষণ শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে কড়াকড়ি মূল্যায়নের ব্যবস্থা না থাকায় সরকারি অর্থ তছরুপ হচ্ছে দিনের পর দিন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নীতি-নৈতিকতা, আচার-আচরণে তেমন কোনো পরিবর্তন আসছে না। যতোদিন পর্যন্ত আমাদের শিক্ষায় গলদ কোথায়, ঘাটতি কী কী-এসব বিষয় চিহ্নিত ও পর্যালোচনা করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হবে, ততোদিন অসভ্য জাতি হিসেবেই আমরা বিবেচিত হতে থাকবো সভ্য দুনিয়ার কাছে। এ লজ্জা একান্ত আমাদের, এর দায়ভার সম্পূর্ণ আমাদেরই।
লেখক: যুগ্ম-পরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।