আর্থিক সংকটেও দেশে বেড়েছে কোটিপতির সংখ্যা - দৈনিকশিক্ষা

আর্থিক সংকটেও দেশে বেড়েছে কোটিপতির সংখ্যা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ক্ষয়িষ্ণু রিজার্ভ, রেমিট্যান্সে ভাটাসহ সামষ্টিক অর্থনীতির নানামুখী সংকটের মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে সরকার ও সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। এমন অবস্থায়ও একশ্রেণীর মানুষের ধনসম্পদ আরো ফুলে-ফেঁপে উঠছে। সুইজারল্যান্ডের ইউবিএস ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশীয় মুদ্রায় ১০০ কোটি টাকার কাছাকাছি বা এর ওপরে সম্পদশালী ব্যক্তির সংখ্যা বাংলাদেশে প্রায় এক হাজার ৭০০, যাদের মোট সম্পদের পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে, স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকার বেশি। যা দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশ।

এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। সর্বশেষ গত আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুসারে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। এতে আমদানির পরিমাণ কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। ফলে উৎপাদনমুখী শিল্পের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ক্রমাগত ক্ষয়ের কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি ক্রমেই নাজুক হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে (বিপিএম৬) দেশের রিজার্ভ এখন ২ হাজার ১৭০ কোটি ডলার বা ২১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত রফতানিতে গত অর্থবছরে প্রত্যাশিত হারে প্রবৃদ্ধি হয়নি। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম আরেক খাত রেমিট্যান্স পরিস্থিতিও আশাব্যঞ্জক নয়। গত অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে নামমাত্র প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমেছে। দেশের ব্যাংক খাতের পরিস্থিতিও নাজুক। সুশাসনের ঘাটতির পাশাপাশি খেলাপি ঋণ খাতটির জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। তবে অর্থনীতির এসব সংকটের আঁচ লাগছে না দেশের বিলিয়নেয়ারদের গায়ে।

ব্যবসায়িক কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সম্পদশালীদের তথ্য সংগ্রহ করে থাকে জুরিখভিত্তিক ক্রেডিট সুইস ব্যাংক। প্রায় দেড় দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সম্পদশালীদের আর্থিক পরিসংখ্যান নিয়ে ডাটাবেজ তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা উইং, যা প্রকাশ হয় গ্লোবাল ওয়েলথ রিপোর্ট শিরোনামে। তবে এ বছর ক্রেডিট সুইসকে অধিগ্রহণ করে নেয় সুইজারল্যান্ডের আরেক ব্যাংক ইউবিএস। ফলে এবার বিশ্বের সম্পদশালীদের ডাটাবেজ প্রকাশ করেছে ইউবিএস ব্যাংক। ডাটাবেজটির সর্বশেষ প্রকাশিত ২০২৩ সালের সংস্করণে দেখা যায়, ২০২২ সাল শেষে দেশে ৫০ কোটি ডলার বা সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ধরে) বেশি পরিমাণের সম্পদ আছে ২২ ব্যক্তির কাছে। যেখানে ২০২১ সাল শেষে এ ক্যাটাগরির সম্পদশালীর সংখ্যা ছিল ২১ জন। ১০ কোটি থেকে ৫০ কোটি ডলার বা ১ হাজার ১০০ কোটি থেকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে ৪৪ জনের কাছে। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৩ জন।

২০২২ সাল শেষে বাংলাদেশে ৫ থেকে ১০ কোটি ডলার বা ৫৫০ কোটি থেকে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদ ছিল এমন ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০ জনে, যা ২০২১ সালে ছিল ৩৯ জন। ১ থেকে ৫ কোটি ডলার বা ১১০ থেকে ৫৫০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা ২০২২ সাল শেষে ছিল ৪২৩ জন। যেখানে ২০২১ সালে এ ক্যাটাগরির সম্পদশালীর সংখ্যা ছিল ৪০০ জন। সব মিলিয়ে দেশে ১১০ কোটি থেকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা ২০২২ সাল শেষে ৫২৯ জনে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫০৩ জন। দেখা যাচ্ছে এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে শতকোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে ২৬ জন। এর মধ্যে ১১০ কোটি থেকে ৫৫০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি ২৩ জন। ইউবিএসের প্রতিবেদনে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি ডলারের সম্পদ রয়েছে এমন বাংলাদেশীর সংখ্যা ২০২২ সাল শেষে ১ হাজার ১৫৬ জনে দাঁড়িয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২১ সাল শেষে যা ছিল ১ হাজার ১২৫ জন। বর্তমান বিনিময় হার বিবেচনায় নিলে ৯০ লাখ ৯১ হাজার ডলারের সম্পদ থাকলে বাংলাদেশী মুদ্রায় তা ১০০ কোটি টাকায় দাঁড়াবে। ফলে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি ডলারের সম্পদ থাকা ১ হাজার ১৫৬ জন ব্যক্তির মধ্যে কিছুসংখ্যক শত কোটিপতির তালিকায় স্থান পাবে। এতে প্রকৃত হিসাবে বাংলাদেশের শত কোটিপতির সংখ্যা ৫২৯ জনের বেশি হবে। স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে ২০২১ সালে এসব সম্পদশালীর টাকার অংকে সম্পদের পরিমাণ ২০২২ সালের তুলনায় কিছুটা কম ছিল।

দেশের অর্থনীতিকে বিপত্তির মুখে ঠেলে দিয়েছিল কভিড মহামারীর প্রাদুর্ভাব। কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন অনেকে। অবনতির দিকে যায় দারিদ্র্য পরিস্থিতি। করোনা প্রাদুর্ভাবের পরের বছর ২০২১ সালটিকে দেখা হচ্ছিল অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বছর হিসেবে। যদিও এ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে তুলেছিল কভিডের নতুন ধরনের আবির্ভাব, নতুন সংক্রমণ ঢেউ ও বিধিনিষেধ। পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে পড়ে বছরের শেষার্ধ্বে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের অস্থিতিশীলতায়। এরপর শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট। ভঙ্গুর হয়ে পড়ে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা। এসব কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির নানামুখী সংকটে প্রতিকূল পরিস্থিতি পার করছে বাংলাদেশ। তবে এসব প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশে বিভিন্ন সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর সম্পদ বৃদ্ধি থেমে থাকেনি, বরং বেড়েছে।

সম্পদের কেন্দ্রীভবনকে বাংলাদেশে সুষম উন্নয়নের পথে অন্তরায় হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘যাদের ধনসম্পদ আছে উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের সংযোগও বেশি। এ সংযোগ রাজনীতি থেকে শুরু করে আমলাতন্ত্র, ব্যাংক সব পর্যায়ে তাদের প্রভাবশালী করছে। ফলে তারা ব্যাংকঋণের সুবিধা পায়। ব্যাংক খাতে দেখা যাবে ঋণের বেশির ভাগই কেন্দ্রীভূত বড় গ্রাহকদের মধ্যে। অঞ্চলভিত্তিক হিসেবে দেখলেও দেখা যাবে চট্টগ্রাম ও ঢাকা ছাড়া বেশির ভাগ এলাকাই বঞ্চিত। আবার আয় বাড়লে ধনীরা জমি-সম্পদ কেনে। প্রয়োজন দুই বিঘা, কিনে রাখে ১০ বিঘা। পরে আট বিঘা বিক্রি করে। স্পেকুলেটরি ইনভেস্ট করে। ওদের কাছে সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশে কয়েকটা ক্ষেত্রে মনোপলি-অলিগোপলি আছে। যেমন বিদ্যুৎ, ব্যাংক, ওষুধ—এসব খাতেই কয়েকটা গ্রুপই সবকিছু করছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র-মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো দিনে দিনে বঞ্চিত হচ্ছে।’

সম্পদশালীদের এ ডাটাবেজের বিষয়ে ক্রেডিট সুইসের ভাষ্য হচ্ছে, তারা মূলত নিট উচ্চমূল্যের সম্পদ মালিকদের (হাই নিট ওয়ার্থ ইন্ডিভিজুয়াল) তথ্য জানতে ডাটাবেজটি নিয়মিতভাবে তৈরি করে থাকে। নিট সম্পদের মালিকানার হিসাব করা হয় ব্যক্তির মালিকানাধীন আর্থিক ও অনার্থিক সম্পদের (স্থাবর সম্পদ যেমন জমি, বাড়ি ইত্যাদি) মোট মূল্য থেকে দায়দেনা বাদ দিয়ে।

দুর্নীতিকে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও দেশের ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির বড় একটি কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মানুষের সম্পদের বিকাশ সম্পূর্ণ বৈধ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হতে পারে। এখানে সম্পদের বৈষম্য পুঁজিবাদের একটা বৈশিষ্ট্যও বটে। তার পরও যে বিষয়টি আমাদের মতো দেশে ঘটছে এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ঘটে, সেটি হলো দুর্নীতি। এর নেতিবাচক প্রভাবগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে যায়। আমাদের নীতিকাঠামোটা অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতিসহায়ক। পৃথিবীর যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি হারে উচ্চধনীর সংখ্যা বাড়ছে, তার অন্যতম হলো বাংলাদেশ।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সম্পদশালীদের তথ্যে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। এটা একটা স্বাভাবিক চিত্র। আগে নিচের সারিতে থাকলেও হয়তো এরই মধ্যে উচ্চধনীর কাতারে চলে গেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পৃথিবীর যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি হারে উচ্চধনীর সংখ্যা বাড়ছে, তার অন্যতম হলো বাংলাদেশ। যাদেরকে বলা হয় সুপার রিচ। বৈষম্যও বাড়েছে। আমাদের জাতীয় আয়ের ৪৪ শতাংশের মালিক হচ্ছে ১০ শতাংশ ধনী ব্যক্তি। ১৬ শতাংশের মালিক হচ্ছে ১ শতাংশ ধনী ব্যক্তি। এতে বোঝা যাচ্ছে যে বৈষম্যটা কত প্রকট।’

ক্রেডিট সুইসের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বের ২১৭টি দেশ ও অর্থনৈতিকভাবে স্বতন্ত্র অঞ্চলে (হংকংয়ের মতো বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল) সম্পদের বণ্টন সংশ্লিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ডাটাবেজটি তৈরি করা হয়েছে। ডাটাবেজটি তৈরি হয়েছে তিনটি ধাপে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে সংশ্লিষ্ট দেশ ও অঞ্চলগুলোর গড় সম্পদের বণ্টন হিসাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বড় একটি উৎস ছিল দেশগুলোর খানা জরিপের তথ্য। যেসব দেশের খানা জরিপের তথ্য পাওয়া যায়নি, সেগুলোর ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানকে ভিত্তি করে সম্পদের বণ্টন হিসাব করা হয়েছে। অনেক দেশেই পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে সংশ্লিষ্ট উপ-অঞ্চলের গড় সম্পদ ও জিডিপির অনুপাতসহ বিভিন্ন উপাত্তের ভিত্তিতে রিগ্রেশন অ্যানালাইসিসসহ কয়েকটি পরিসংখ্যান পদ্ধতির প্রয়োগ করতে হয়েছে।

সাবেক সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে অবশ্যই ধনীদের সম্পদের পরিমাণ বাড়ছে। এক্ষেত্রে জবাবদিহিতা, সুশাসন ও রাজনৈতিক অর্থনীতির দিকভ্রান্তির প্রভাব রয়েছে। ফাঁকি দিয়ে হোক, দুর্নীতি করে হোক এ সম্পদ যদি অর্থনীতিতেই থাকত, তাহলে অর্থনীতি অন্তত আরো ৭৫ শতাংশ উপযোগিতা পেত। কারণ মানুষের কর্মসংস্থান হতো। অর্থ দেশেই থাকত এবং দেশেই প্রবাহিত হতো। এক্ষেত্রে প্রথম অন্যায় যেটি হচ্ছে সেটি হলো ফাঁকি দিয়ে বা দুর্নীতি করে সবার কাছ থেকে সম্পদ কুড়িয়ে নেয়া হচ্ছে। যাদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে তাদের দিকে না তাকিয়ে বা ফেলে দিয়ে অর্থ নেয়া হচ্ছে বিদেশে। সেখানে সম্পদ গড়ে উঠছে, কর্মসৃজন হচ্ছে, উন্নতি হচ্ছে। এগুলো এখানেই ঘটতে পারত। এসব কিছুর প্রতিফলন হিসেবে বৈষম্য বাড়ছে। দেখা যাবে যে সংস্কার দেশে প্রয়োজন সেটা এ দুর্নীতিবাজরাই করতে দেবে না। দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ঠিকভাবে কাজ করতে পারত তাহলে আজ দেশের এ অবস্থা হয় না।’

তিনি বলেন, ‘এখন কালো টাকা সাদা করা, বিশেষ করে বিদেশে পাচার করার টাকা আনার বিষয়ে বলা হচ্ছে, তবে উৎসের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করা হচ্ছে না। এ একটি ধারা পরিস্থিতিটাকে সবচেয়ে বেশি জটিল করেছে। অর্থাৎ টাকা দুর্নীতি করে নিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, সেই টাকা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না, এ ধরনের অ্যামনেস্টি দেয়ার কারণে বিদেশে টাকা পাচারসহ কালো টাকার পরিমাণ বাড়ছে। অর্থাৎ প্রশ্রয় পাওয়ার বিষয়টি এক্ষেত্রে একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।’

ক্রেডিট সুইসের ডাটাবেজ তৈরির দ্বিতীয় ধাপে পর্যালোচনা করা হয় সংশ্লিষ্ট দেশ বা অঞ্চলগুলোর সম্পদ মালিকানার ধরনকে। এক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায় ৪০টি দেশের। এসব দেশের তথ্য পর্যালোচনায় সম্পদ ও আয়ের বণ্টনের মধ্যে সরাসরি সম্পর্কের প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা। এ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে আরো ১৪০টি দেশের পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে। এসব দেশের আয়ের তথ্য পাওয়া গেলেও সম্পদের মালিকানা সম্পর্কে বিশদ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বাকি ৩৭টি দেশের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট উপ-অঞ্চলের গড়ের আশ্রয় নিতে হয়েছে বিশেষজ্ঞদের।

তৃতীয় ধাপে হিসাব করা হয়েছে বিভিন্ন দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বা অতিধনীদের সম্পদের পরিমাণকে। এক্ষেত্রেও গতানুগতিক উৎসগুলোকে অনির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন ক্রেডিট সুইসের গবেষকরা। এজন্য বিভিন্ন দেশের শীর্ষ ধনীদের মধ্যে সম্পদের বণ্টন পর্যালোচনার জন্য অন্যান্য উৎসের পাশাপাশি ফোর্বসের বৈশ্বিক বিলিয়নেয়ারদের তালিকার সহায়তা নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সম্পদের মূল্য হিসাব করা হয়েছে ডলারের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিময় হারের ভিত্তিতে। এ বিষয়ে ক্রেডিট সুইসের বক্তব্য হলো, গোটা বিশ্বেই শীর্ষ পর্যায়ের ধনীদের মধ্যে এক দেশ থেকে আরেক দেশে সম্পদ স্থানান্তরের প্রবণতা আছে। এ কারণে বৈশ্বিক সম্পদের বণ্টন পর্যালোচনা করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিময় হারকেই বিবেচনায় নেয়া উত্তম।

অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তিনটি উপায়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় টাকা আসে। একটা হচ্ছে বড় প্রকল্প, দ্বিতীয়ত হচ্ছে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক সখ্য। আরেকটি উপায় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে যাদের টাকা বেড়েছে তারা বিদ্যুৎ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং বৃহৎ অবকাঠামোর স্থানীয় কন্ট্রাক্টর। এছাড়া বিরাট একটা অংশ আছে যাদের টাকা বেড়েছে। তারা সরকারি কর্মকর্তা।’

ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা বলছেন, সম্পদ বৃদ্ধির এ পরিসংখ্যানকে ব্যক্তি খাতের বিকাশেরই প্রতিফলন। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশের পথে রয়েছে। এখানে নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে, নতুন নতুন খাতের বিকাশ ঘটছে। কেউ ভালো করছেন, কেউ পারছেন না। অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে ব্যক্তি খাতের ওপরে। এ খাতে সম্পদ বাড়ছে। সরকারের সহায়তায় অনেক নতুন নতুন খাত উন্মুক্ত হচ্ছে, যেমন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, আইটি, ব্যাংকিং। এর প্রভাবে বড় করপোরেটগুলোর সুযোগ বেড়েছে, তারা ভালো করছে। কিন্তু সমতা আনার জন্য একটা প্রচেষ্টা আমাদের থাকতে হবে। বিশেষ করে ব্যাংক খাতকে এগিয়ে আসতে হবে এসএমই খাত বিকাশের জন্য। বৈষম্য অবশ্যই আছে। এটি কমানোর জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দেশে ব্যবসা করলে কর্মসংস্থান হয়। এখন ব্যবসা যদি বাংলাদেশের মধ্যেই থাকে তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যদি ড্রেন আউট হয়ে যায় বা চলে যায় তাহলে তা আমাদের জন্য কঠিন। এজন্য ভারসাম্য থাকা দরকার।

দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সম্পদশালী বৃদ্ধির চিত্রটি প্রবৃদ্ধির প্রতিফলন। সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচক ধরে নিতে পারি। মানুষের আয় বাড়ছে। মধ্যবিত্ত থেকে ধনী হচ্ছে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন ঘটছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যারা দেশের সম্পদ দেশেই কাজে লাগাচ্ছেন তাদের মাধ্যমে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে। তবে বাংলাদেশ থেকে যদি ড্রেন আউট হয়ে যায় বা চলে যায় সেটা ঠিক না। যারা এমনটা করছেন তারা দেশের শত্রু।’

দেশে অতিধনীর সংখ্যা বাড়লেও আয়করের ৮৫ শতাংশই আসছে পরোক্ষ উৎস থেকে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দুর্বল করভিত্তি বাংলাদেশেই। অতিধনীদের বিরাট অংশ দেশে কর না দিয়ে সম্পদ পাচার করছেন ভিনদেশে। অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করছেন অথবা রেসিডেন্স পারমিট নিচ্ছেন গোল্ডেন ভিসায়। বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন অফশোর গন্তব্যে জমা রাখছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। কানাডা, দুবাই, লন্ডনের প্রাইম লোকেশনে কিনছেন উচ্চমূল্যের বাড়ি। বিদেশী গন্তব্যে অর্থের এ অবৈধ প্রবাহ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর বড় চাপ তৈরি করেছে।

ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মঈনউদ্দীন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা দেখছি, দেশে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী রাতারাতি ধনী হয়ে যাচ্ছেন। আবার ব্যবসা-বাণিজ্য নেই এমন ব্যক্তিদের সম্পদও ফুলে-ফেঁপে উঠছে। নীতি-নৈতিকতা ও আইন অনুসরণ করে কোনো দেশেই রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তার মানে হঠাৎ সম্পদশালী হয়ে উঠতে হলে বেআইনি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে হয়। ঘুস, অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয়।’

তিনি মনে করেন, দেশে জনগণের মাথাপিছু আয় বাড়লেও মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর আয় কমে যাচ্ছে। মূলত ধনীরা আরো ধনী হয়ে ওঠার প্রভাব মাথাপিছু আয়ে পড়ছে। জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম অংশকে দারিদ্র্যের মধ্যে রেখে কোনো দেশ বা জাতির উন্নতি টেকসই হয় না। উন্নয়নের সুফল সব শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে কার্যকর সুশাসন দরকার।

যেসব চাকরির পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha যেসব চাকরির পরীক্ষা স্থগিত কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে সরকার - dainik shiksha কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে সরকার উত্তরায় গুলিতে ২ শিক্ষার্থী নিহত - dainik shiksha উত্তরায় গুলিতে ২ শিক্ষার্থী নিহত ছাত্রলীগ আক্রমণ করেনি, গণমাধ্যমে ভুল শিরোনাম হয়েছে - dainik shiksha ছাত্রলীগ আক্রমণ করেনি, গণমাধ্যমে ভুল শিরোনাম হয়েছে সহিংসতার দায় নেবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - dainik shiksha সহিংসতার দায় নেবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জবিতে আজীবনের জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আশ্বাস প্রশাসনের - dainik shiksha জবিতে আজীবনের জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আশ্বাস প্রশাসনের মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানালেন পলক - dainik shiksha মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানালেন পলক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027692317962646