রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের পারিবারিক পটভূমি তাদের পরবর্তীকালের জীবন-জীবিকাকে প্রভাবিত করেছে। রামমোহনের পিতা সম্পত্তিশালী ছিলেন। পুত্রকে রাজ-সরকারের কাজের উপযোগী করে গড়ে তুলতে বাড়িতেই রাজভাষা ফার্সি শিক্ষার ব্যবস্থা করেন এবং নয় বছর বয়সে উত্তমরূপে ফার্সি ও আরবি শেখার জন্য পাটনা পাঠান। বারো বছর বয়সে তিনি সংস্কৃত শেখার জন্য রামমোহনকে কাশীতেও পাঠান। কিন্তু বিদ্যাসাগরের পিতা ছিলেন অতিদরিদ্র। মাসিক মাত্র দশ টাকা বেতনে কলকাতায় এক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তিনি চেয়েছিলেন তার পুত্র উত্তম সংস্কৃত শিক্ষা লাভ করে পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী গ্রামে একটি চতুষ্পাঠী খুলুক। তাই দেখি, যে বয়সে রামমোহন ফার্সি-আরবি রপ্ত করতে পাটনা যাচ্ছেন, প্রায় একই বয়সে ঠাকুরদাস নিজের চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও ছেলেকে কলকাতায় রেখে সংস্কৃত শেখাচ্ছেন। একজন ভবিষ্যৎ সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের রাজভাষা ফার্সি শেখার কোনো প্রয়োজন ছিলো না বলে বিদ্যাসাগরকে ফার্সি শিখতে হয়নি। এটি তার সময়ের অন্যান্য শিক্ষিত লোকের তুলনায় বিদ্যাসাগরের একটি সীমাবদ্ধতাও বটে। রামমোহন ও বিদ্যাসাগর প্রায় একই বয়সে, একুশ-বাইশ বছরে, ইংরেজি শিখতে শুরু করেন। রামমোহন পরবর্তীকালে আরো বেশ কয়েকটি ভাষা শিখেছিলেন। আরবি-ফার্সি ভাষার ওপর এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানের জন্য তাকে ‘জবরদস্ত মৌলভি’ বলা হতো। বিভিন্ন ভাষার ওপর দখল তাকে বিবিধ বিষয়ে বহুমুখী জ্ঞানার্জনে সাহায্য করে। তিনি যখন ইংরেজ কালেক্টর জন ডিগবির অধীনে কেরানির চাকরি নেন তার আগেই কলকাতায় মহাজনি কারবার ও কোম্পানির শেয়ারের ব্যবসা করে প্রচুর অর্থশালী হয়েছেন এবং জমিদারিও কিনেছেন। তারপরও ইংরেজ সরকারের নিম্নপদে চাকরি নেয়ার পেছনে পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী সরকারি চাকরির প্রতি একটি মোহ হয়তো কাজ করেছে। কেরানিগিরি দিয়ে শুরু করলেও রামমোহন ‘দেওয়ান’ পর্যন্ত হয়েছেন। অন্যদিকে বিদ্যাসাগর তার পূর্বপুরুষদের মতো ঠিক টুলো পণ্ডিত না হলেও একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতই হয়েছিলেন।
রামমোহন রায় আরবি-ফার্সি ভালোভাবেই শিখেছিলেন। তিনি আরবি ভাষায় কেবল কোরানই পড়েননি, ইউক্লিড, প্লেটো-অ্যারিস্টটলের রচনাও পড়েছিলেন আরবি ভাষায়। ফার্সিতে সুফি কবিদের কাব্য পড়েছেন। এসব পড়েই তার ধর্মচিন্তায় নতুন বাঁক আসে। তিনি মূর্তিপূজাবিরোধী একেশ্বরবাদী হয়ে ওঠেন। তিনি বেদান্তেও একেশ্বরবাদের সন্ধান পান এবং রংপুর কালেক্টরেটে কাজ করার সময় থেকে এক ঈশ্বরের বা পরমব্রহ্মের উপাসনা প্রচার শুরু করেন। পৌত্তলিকতাবিরোধী ধর্মমতের জন্য তিনি পিতা-মাতারও বিরাগভাজন হন এবং তারা একাধিকবার তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। ফার্সি ভাষায় লেখা তার বই তুহফাত-উল-মুওয়াহিদ্দীন ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে, তার ৩২ বছর বয়সে, মুর্শিদাবাদে প্রকাশিত হয়। এই বইতে প্রচলিত নানা ধর্মমত সম্পর্কে তার চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়। বইটি তিনি ফার্সিতে লিখেছিলেন কারণ বাংলা ভাষা তখনো গুরুগম্ভীর বিতর্কমূলক বিষয় আলোচনার ভাষা হয়ে ওঠেনি। কিছুদিন পর তার হাত ধরেই বাংলা ভাষার সেই সক্ষমতা তৈরি হয়।
রামমোহন রায়কে শুধু বাংলার নয় সারা ভারতের একজন আধুনিক চিন্তার পথিকৃৎ বলা যায়। ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, ভাষা, রাজনীতি – এরকম সকল বিষয় নিয়ে তিনি ভেবেছেন, লিখেছেন এবং একটি যুক্তিবাদী অবস্থান থেকে তিনি যেভাবে কথা বলেছেন-তা এর আগে কেউ বলেননি। তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার ও অলৌকিকতার প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন এবং তার সমসাময়িক ব্যক্তিবর্গের (যাদের মধ্যে ইংরেজি শেখা লোকও ছিলেন) চেয়ে চিন্তাভাবনায় দৃশ্যমানভাবে পৃথক ও অগ্রসর ছিলেন। ইংরেজি শিক্ষার স্কুল স্থাপন, বাংলায় ও ফার্সিতে পত্রিকা সম্পাদনা, রাষ্ট্রচিন্তা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার হওয়া, কালাপানি পার হয়ে বিলেত যাত্রা এরকম কাজে বর্ণিল তার জীবন। আধুনিক যুগে তিনিই প্রথম বাঙালি যার লেখা বই বিদেশে ছাপা হয়েছে ও যার পরিচিতি বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
সতীদাহ প্রথা রোধে বিশেষ ভূমিকা রামমোহন রায়ের প্রধান কীর্তি হিসেবে পরিচিত। অবশ্য সতীদাহ নিবারণের জন্য রামমোহনের বহু আগে ইংরেজ সরকার থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। সতীদাহের ওপর নানা বিধিনিষেধ, কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিলো এবং আইন করে সতীদাহ নিষিদ্ধ করার কথাবার্তাও শুরু হয়েছিলো। আবার ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দেই সুপ্রিম কোর্টের পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার আদালতে সহমরণ প্রথার বিপক্ষে মতামত দিয়েছিলেন।
পরের বছর, ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে রামমোহন রায় তার সহমরণ বিষয় প্রবর্তক-নিবর্তকের সম্বাদ-এ মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের অনুরূপ শাস্ত্রীয় যুক্তিতেই সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন, যে হিন্দুশাস্ত্রমতে মৃত স্বামীর সঙ্গে পুড়ে মরে ‘সতী’ হওয়ার চেয়ে ব্রহ্মচর্য বা চিরবৈধব্য উত্তম। এই পুস্তিকা প্রকাশের পর সতীদাহের পক্ষে-বিপক্ষে তীব্র বিতর্ক শুরু হয় এবং রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথাবিরোধিতার একজন প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হন। উইলিয়াম বেন্টিংক গভর্নর জেনারেল হওয়ার পর আইন করে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি এ-বিষয়ে রাজা রামমোহন রায় এবং আরো কয়েকজন ব্যক্তির মতামত জানতে চান। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় ছিলো, রামমোহন রায় আইন করে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। কারণ তার আশঙ্কা ছিলো, আইন করে এই প্রথা বন্ধ করলে লোকে মনে করবে মুসলমান শাসকদের মতো ইংরেজরাও হিন্দুদের ওপর তাদের ধর্ম চাপিয়ে দেয়ার পাঁয়তারা করছেন। তার মত ছিলো, নীরবে কিছু প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং পুলিশের অপ্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সহমরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এই প্রথা রোধ করা সম্ভব হবে। তবে ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর আইনটি পাস হওয়ার পর তিনি আইনটিকে স্বাগত জানান। রক্ষণশীল হিন্দুরা আন্দোলন শুরু করলে এবং প্রিভি কাউন্সিলে আপিল করলে তিনি তার ‘আত্মীয় সভা’কে সঙ্গে নিয়ে এই আইনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন।
বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি হিসেবে পরিচিত বিধবাবিবাহ প্রবর্তন। বিদ্যাসাগর নিজেও বলেছেন, এটি তার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ আন্দোলন শুরু করেন সতীদাহ প্রথা বন্ধ হওয়ার চব্বিশ বছর পর। তখনো বিধবাবিবাহের বিপক্ষে একটি শক্তিশালী মত থাকলেও নিষ্পাপ বালবিধবাদের দুঃখ যেমন সমাজমানসে করুণা, সহানুভূতি জাগ্রত করেছিলো তেমনি এই কুপ্রথার কারণে সমাজে বিদ্যমান যৌন-অনাচার একটি অস্বস্তিও তৈরি করেছিলো। বিদ্যাসাগরের পূর্বেই ইয়াং বেঙ্গল গোষ্ঠীর পত্রিকা বেঙ্গল স্পেক্টেটর বিধবাবিবাহের পক্ষে সোচ্চার ছিলো। বেশকিছু ব্যক্তি তাদের বিধবা কন্যার বিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যদিও সফল হননি। ধনাঢ্য ও রক্ষণশীলদের অন্যতম নেতা মতিলাল শীলও বিধবাবিবাহ প্রচলনের চেষ্টা করেছিলেন এবং ঘোষণা করেছিলেন, যে প্রথম বিধবাবিবাহ করবে তাকে তিনি বিশ হাজার টাকা পুরস্কার দেবেন। ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় ল’কমিশন বিধবাবিবাহ প্রচলন আইন করার উদ্যোগ গ্রহণ করে; কিন্তু হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কারের ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে বলে কিছু ইংরেজ কর্মকর্তার ভিন্নমতের জন্য তখন আইনটি করা হয়নি। বিদ্যাসাগর ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করার পর বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে এবং বিদ্যাসাগর তার অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হলেন। রামমোহন আইন করে সতীদাহ বন্ধ করা পক্ষে না থাকলেও, বিদ্যাসাগরের মূল লক্ষ্যই ছিলো বিধবাবিবাহের সমর্থনে আইন পাস করা। এই দুটি আইনের চরিত্রগত পার্থক্য ছিলো। সহমরণ নিবারণ আইন চূড়ান্তভাবে পাস হওয়ার পর সতীদাহ ফৌজদারি আদালতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় এবং এই আইন কার্যকর করার দায়িত্ব ইংরেজ সরকারের ওপর বর্তায়। কিছুদিনের মধ্যেই সতীদাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং এরপর সহমরণবিরোধীদের আর কিছু করার ছিলো না। রামমোহন রায় এরপর ইংল্যান্ড থেকে আর দেশে ফিরে আসেননি। কিন্তু বিধবাবিবাহ আইন পাস হওয়ার পরই ছিলো বিদ্যাসাগরের আসল কাজ। বিধবাবিবাহ আইন বিধবাবিবাহ আইনসম্মত করেছিলো। কিন্তু আইনসম্মত হতেই বিধবাদের বিয়ে হওয়া আদৌ শুরু হয়নি। বিধবাবিবাহ চালু করতে বিদ্যাসাগর ও তার সমর্থকদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। নানা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়েছে। এর জন্য বিদ্যাসাগরকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে, ঋণের বোঝা মাথায় নিতে হয়েছে। এসব কারণে তার নাম হয়েছিলো ‘বিধবার বিদ্যাসাগর’।
লেখক : প্রাবন্ধিক