পয়লা মে, মহান মে দিবস। সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দিবসটি পালন করা হয়। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ওই দিন অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে কয়েকজন শ্রমিককে জীবন দিতে হয়। এর পর থেকে দিনটি ‘মে দিবস’ হিসেবে সারা বিশ্বে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে।
ইসলামে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কুরআনুল কারিম ও হাদিস শরিফে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আজ অবধি পৃথিবীতে যা কিছু গড়ে উঠেছে তা সবই শ্রমের ফল এবং শ্রমিকের কৃতিত্ব। ইসলাম শ্রমিক এবং শ্রমকে যথার্থ মূল্যায়ন করেছে। একমাত্র ইসলাম ধর্মই শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে মূলনীতি ও বিধান প্রবর্তন করেছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদের সার্বভৌমত্ব ও মালিকানা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর, আর মানুষ তার তত্ত্বাবধায়ক মাত্র। সুতরাং এখানে মালিক-শ্রমিক সবাই ভাই ভাই। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা-স্নেহ, সৌহার্দ ও বিশ্বস্ততায় ভরপুর। শ্রমিক ও মালিক উভয়ের নিজ নিজ প্রাপ্য বুঝে পাওয়ার অধিকার রয়েছে। উভয়কে বলা হয়েছে নিজ নিজ কর্তব্য পালনে দায়িত্বশীল হতে। শুধু মালিক বা শ্রমিক নয়; বরং উভয়কে সুসংহত আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে।
ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে বহু নির্দেশনা রয়েছে। শ্রমের প্রতি উৎসাহ দিয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর যখন নামাজ পূর্ণ করা হবে, তখন জমিনে ছড়িয়ে পড়ো; আর আল্লাহকে অধিক মাত্রায় স্মরণ করো, আশা করা যায় তোমরা সফল হবে’- (সুরা জুমুআহ, আয়াত ১০)। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘ফরজ ইবাদতগুলোর পরেই হালাল উপার্জন ফরজ দায়িত্ব’- (তিরমিজি)। ‘হালাল উপার্জনগুলোর মধ্যে তা সর্বোত্তম, যা কায়িক শ্রম দ্বারা অর্জন করা হয়’- (মুসলিম)।
ইসলামে শ্রমিক ও মালিক পরস্পরকে ভাই সম্বোধন করে মূলত ইসলাম শ্রেণি ও বর্ণ বৈষম্যের বিলোপ করেছে। তবে শ্রেণিবৈষম্য বিলোপের নামে মালিক ও উদ্যোক্তার মেধা, শ্রম ও সামাজিক পদ মর্যাদাকে অস্বীকার করেনি ইসলাম। চাপিয়ে দেয়নি নিপীড়নমূলক কোনো ব্যবস্থা। বরং তার ভেতর মানবিক মূল্যবোধ ও শ্রমিকের প্রতি মমতা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ তাআলা জীবনোপকরণে তোমাদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। যাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে তারা তাদের অধীন দাস-দাসীদের নিজেদের জীবনোপকরণ থেকে এমন কিছু দেয় না যাতে তারা তাদের সমান হয়ে যায়। তবে কি তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করে?- (সুরা নাহল, আয়াত ৭১)।
উল্লিখিত আয়াতে যেমন মালিকের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করা হয়েছে, তেমনি তার অহংবোধ ও শ্রেণিবৈষম্যের ধারণার নিন্দা করা হয়েছে। পাশাপাশি সম্পদের প্রকৃত মালিকানা ও তা অর্জন করতে পারা যে একান্তই আল্লাহর অনুগ্রহ সেটাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেন সে মানবিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণে মনোযোগী হয়।
ইসলাম শ্রমের শ্রেণিবিন্যাসকে স্বীকার করলেও মানবিক মূল্যবোধ ও মৌলিক মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবাই সমান। রাসুলুল্লাহ (সা.) ব্যবসা, কৃষি ও দ্বীনচর্চাকে উৎসাহিত করেছেন। আবার মর্যাদার ক্ষেত্রে সব শ্রমিক সাধারণভাবে সমান ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, শ্রমজীবী মানুষ আল্লাহর বন্ধু। ইসলাম শ্রমিককে বলেছে, দক্ষ, বিশ্বস্ত ও দায়িত্ববান হতে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেই মা খাদিজা (রা.) এর ব্যবসা বাণিজ্য একজন বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে দেখাশোনা করেছেন। কোরআনে আদর্শ শ্রমিক হিসেবে হজরত মুসা (আ.)-এর বৈশিষ্ট এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে পিতা! আপনি তাকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিন। নিশ্চয় আপনার শ্রমিক হিসেবে সে-ই উত্তম যে সামর্থ্যবান ও বিশ্বস্ত’- (সুরা কাসাস, আয়াত ২৬)।
পরবর্তী আয়াতে নিয়োগদাতা শোয়াইব (আ.)-এর সঙ্গে নিয়োগপ্রাপ্ত মুসা (আ.)-এর মজুরি নির্ধারণের বিবরণ এসেছে। পরে বিরোধ এড়াতে উভয়ের সম্মতিতে প্রথমেই মজুরি নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামী শ্রমনীতির শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বাতন্ত্র্য এখানেই যে ইসলাম মালিক ও শ্রমিকের জন্য অভিন্ন খাবার ও বস্ত্রের নির্দেশ দিয়েছে। এই নির্দেশনার আলোকে বোঝা যায়, ইসলাম একটি উচ্চ মানসিকতাসম্পন্ন শ্রমনীতির কথা বলেছে, যেখানে শ্রমিকের মানসম্মত জীবন-জীবিকা নিশ্চিত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং যার ভাইকে তার অধীন করেছেন সে যেন তাকে তাই খাওয়ায় যা সে খায়, সে কাপড় পরিধান করায়, যা সে পরিধান করে। তাকে সামর্থ্যের অধিক কোনো কাজের দায়িত্ব দেবে না। যদি এমনটা করতেই হয়, তাহলে সে যেন তাকে সাহায্য করে’- (বুখারি, হাদিস ৫৬১৭)।
ইসলাম ভিক্ষা ও তালাককে বৈধ ঘোষণা করেছে ঠিকই কিন্তু একই সাথে একাজ দুটিকে চরম অপছন্দনীয় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, এক লোক এসে নবীজি (সা.)–এর কাছে ভিক্ষা চাইলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কি কিছুই নেই?’ সে বলল, ‘আমার একটি কম্বল আছে।’ নবীজি বললেন, ‘যাও কম্বলটি নিয়ে এসো।’ কম্বল নিয়ে এলে নবীজি (সা.) তা নিলামে দুই দিরহাম মূল্যে বিক্রয় করলেন। এক দিরহাম তাকে দিয়ে দিলেন পরিবারের খাবারের ব্যবস্থা করতে আর এক দিরহাম দিয়ে কুড়াল কিনে নবীজি (সা.) নিজ হাতে তাতে হাতল লাগিয়ে দিলেন; আর ওই লোককে কাঠ কেটে উপার্জন করার নির্দেশ দিলেন- (বুখারি ও মুসলিম)।
সব নবীই কায়িক পরিশ্রম করে জীবিকা উপার্জন করেছেন। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মা খাদিজা (রা.)–এর কোম্পানিতে দীর্ঘকাল সততা, বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার সাথে চাকরি করেছেন। হজরত নূহ (আ.) কাঠমিস্ত্রি বা সুতারের কাজ করেছেন। হজরত ইদ্রিছ (আ.) সেলাইয়ের কাজ করতেন। হজরত সুলাইমান (আ.)–এর পিতা নবী ও সম্রাট হজরত দাউদ (আ.) লৌহশিল্প বা কামারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এমনকি নবী হজরত শুআইব (আ.)–এর খামারে হজরত মুসা (আ.) ৮-১০ বছর চাকরি করেছেন। তারা কেউই কাজকে অবজ্ঞা করেননি, বরং রিজিকের ফায়সালা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
বেতন ও পারিশ্রমিক কর্মজীবীর ন্যায্য অধিকার। ইসলাম দ্রুততম সময়ে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও’- (ইবনে মাজাহ, হাদিস ২৪৪৩০)। অন্য হাদিসে পারিশ্রমিক ও প্রাপ্য অধিকার নিয়ে টালবাহানাকে অবিচার আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘ধনী ব্যক্তির টালবাহানা অবিচার’- (সহিহ বুখারি, হাদিস ২২৮৭)। অর্থাৎ সামর্থ্য থাকার পরও মানুষের প্রাপ্য ও অধিকার প্রদানে টালবাহানা করা অন্যায়। আর ঠুনকো অজুহাতে বেতন-ভাতা ও প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ভয়ংকর অপরাধ। মহানবী (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির বিপক্ষে থাকব। ---- আর একজন সে যে কাউকে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার পর তা থেকে কাজ বুঝে নিয়েছে অথচ তার প্রাপ্য দেয়নি’- (বুখারি, হাদিস ২২২৭)। শ্রমিকের অধিকার ও মানবিক মর্যাদা এবং মালিকের প্রাপ্য সেবা লাভের এমন ভারসাম্যপূর্ণ শ্রমনীতি একমাত্র ইসলামই দিয়েছে।
শ্রমিকের মর্যাদাপূর্ণ জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মালিকেরই দায়িত্ব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মালিকানাধীন (অধীন) ব্যক্তির জন্য খাবার ও কাপড়ের অধিকার রয়েছে’- (মুসলিম, হাদিস ১৬৬২)। ক্ষতিগ্রস্ত বা অক্ষম শ্রমিক ও তার পরিবারের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যারা সম্পদ রেখে যাবে, তা তাদের উত্তরাধিকারীরা পাবে আর যারা অসহায় পরিবার-পরিজন রেখে যাবে, তা আমাদের (সরকার ও মালিকপক্ষের) দায়িত্বে’- (বুখারি, মুসলিম ও বায়হাকি)। অন্যদিকে, যে শ্রমিক আপন কর্তব্য পালনের পাশাপাশি আল্লাহর ইবাদত করেন, তাঁদের বিষয়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যারা মালিকের হক (দায়িত্ব) আদায় করার পাশাপাশি আল্লাহর হক (ইবাদত)ও পালন করে, তারা দ্বিগুণ সওয়াব পাবে’- (বুখারি ও মুসলিম; মিশকাত)।
বিদায় হজ্জের ভাষণে হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছিলেন, প্রত্যেক মুসলমান ভাই ভাই। তোমরা তোমাদের দাস-দাসী সম্পর্কে সতর্ক থাকবে। তোমরা যা খাবে তাদেরও তা খেতে দেবে। তোমরা যা পরিধান করবে তাদেরও তা পরতে দেবে। তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবে। শাস্তি দেবে না। ভাষণ শেষে কুরআনের শেষ আয়াতটি নাজিল হয়েছিলো। ‘আজকের এই দিনে তোমাদের দীনকে পূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকেই তোমাদের ওপর দীন হিসেবে মনোনীত করলাম’- (সূরা মায়েদা আয়াত ৩)।
শ্রমিক ঠকানো ইসলামের দৃষ্টি জঘন্যতম পাপ; বরং ইসলামের নির্দেশনা হলো, শ্রমিক তার প্রাপ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হলেও মালিক তাকে প্রাপ্য বুঝিয়ে দেবে। মহানবী (সা.) এই ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘যে জাতির দুর্বল লোকেরা জোর-জবরদস্তি ছাড়া তাদের পাওনা আদায় করতে পারে না, সেই জাতি কখনো পবিত্র হতে পারে না’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস ২৪২৬)। হাদিসে কুদসিতে আছে: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি তাদের বিরুদ্ধে থাকবো, যারা বিশ্বাসঘাতকতা করে, মানুষকে বিক্রি করে এবং ওই ব্যক্তি যে কাউকে কাজে নিয়োগ করলো, অতঃপর সে তার কাজ পুরোটা করলো; কিন্তু সে তার ন্যায্য মজুরি দিলো না’- (বুখারি)। হাদিস শরিফে আছে, ‘যদি কেউ কারও ন্যায্য পাওনা অস্বীকার করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য বেহেশত হারাম করে দেন’ (মুসলিম)। তাই আসুন আমরা সকলে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার ও হক আদায় করে সুষম সমাজ গঠনে আত্মনিয়োগ করি।
লেখক : জিল্লুর রহমান, ব্যাংকার ও কলামিস্ট