উচ্চশিক্ষায় ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ - দৈনিকশিক্ষা

উচ্চশিক্ষায় ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’

মো. নজরুল ইসলাম |

গত ১ জুলাই শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই উচ্চশিক্ষার পীঠস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে নিয়ে তারা মাঠে অবস্থান করছেন। চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলেও আন্দোলন যেনো শেষ হয়েও শেষ হয়নি অদ্যাবধি। গণ-অভ্যুত্থানে পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যদের অনেকেই স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছেন অথবা উপাচার্যের পদ ছেড়ে স্ব-স্ব বিভাগে যোগদান করেছেন, আবার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জোরপূর্বক অনেক উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রশাসনসহ সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা একেবারেই স্থবির হয়ে পড়েছে। আবাসিক হলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনসমূহ খুলে দিলেও ক্লাস অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। কারণ, সেখানে ফিরে আসেনি শিক্ষার পরিবেশ। 

দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষক ও কর্মকর্তা কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। সাধারণত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য না থাকলে উপ-উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য না থাকলে কোষাধ্যক্ষ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে প্রশাসন ব্যবস্থা চালু রাখেন কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন বর্ণিত পদগুলোর সবই শূন্য হয়ে যাওয়ায় উচ্চশিক্ষা হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। আশার কথা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই সংকট নিরসনে উদ্যোগী হয়েছেন কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে অন্য জায়গায়। বিগত দুই দশকে যারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন তাদের অধিকাংশই মেধাভিত্তিক না হয়ে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় মানসম্পন্ন ও দক্ষ শিক্ষক/কর্মকর্তার সংকটে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করতে এবং সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য যেরকম যোগ্য, দক্ষ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তির প্রয়োজন ঠিক তেমনটি খুঁজে পেতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। উপাচার্য পদটি একটি প্রশাসনিক পদ, কাজেই একজন ভালো শিক্ষক হলেই তিনি ভালো উপাচার্য হবেন এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।

দক্ষ প্রশাসক হতে হলে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন এবং প্রশাসনিক প্রশিক্ষণ আবশ্যক। পুঁথিগত বিদ্যা, আকর্ষণীয় একাডেমিক রেকর্ড অথবা কোমল হৃদয়ের অধিকারী-এর কোনোটাই দক্ষ প্রশাসক হবার নিশ্চয়তা দেয় না। তবে দক্ষ প্রশাসকের এই গুণগুলোও থাকতে হয়। প্রশাসককে ন্যায়বিচারের স্বার্থে কখনো কখনো অত্যন্ত কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হয়। সেক্ষেত্রে কোমল অনুভূতিতে কাতর এবং নমনীয় স্বভাবের হলে চলে না। প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা, নিষ্ঠা এবং নিয়মানুবর্তিতার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দিলে প্রশাসন ভেঙে পড়তে বেশি সময় লাগে না। যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবেন তার অবশ্যই উজ্জ্বল একাডেমিক রেকর্ডের সঙ্গে সঙ্গে চমকপ্রদ ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের গুণাবলি থাকতে হবে যা দিয়ে তিনি ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ করবেন এবং একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মান অর্থাৎ বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা বিধানে সক্ষম হবেন। উপাচার্য পদটি শিক্ষকদের জন্য সর্বোচ্চ সম্মানের। বিধায় উপাচার্য কোনো হীন রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলবেন না অথবা অন্য কোনো অনৈতিক ও গর্হিত কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়াবেন না-এটিই বাঞ্ছনীয়। তার পদের সম্মান এবং মর্যাদা বহনে কোনোরূপ শৈথিল্য প্রদর্শনের অবকাশ নেই। যদিও কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশে আমরা ঠিক এর বিপরীত চিত্রই দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। অতীতে দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্রের প্রাণহানি ঘটলে অথবা ক্যাম্পাসে নিয়মশৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটলে উপাচার্য তার নিজের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করতেন কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ঘটছে অন্য ঘটনা। শত ব্যর্থতার পরও পদত্যাগ তো দূরে থাক টেনেহিঁচড়ে তাকে ক্ষমতা থেকে নামানো যাচ্ছে না। ক্ষমতার মোহ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখছে। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে তিনি চেয়ার আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইছেন। বিশ্ববিদ্যালয় তথা দেশের স্বার্থকে থোড়াই কেয়ার করে তিনি নিজের বৈষয়িক উন্নতির স্বপ্নে বিভোর হয়ে হীন স্বার্থের মৌচাক থেকে মধু পান করে চলেছেন। শিক্ষার মান যে তলানিতে ঠেকে গেছে সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। 

মাঝে মধ্যেই আমরা দেখতে পাই সারা বিশ্বের মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিংয়ে ১ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই, যা সচেতন মহলকে সাংঘাতিকভাবে উদ্বিগ্ন করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা বলতে কিছুই নেই এবং আমরা বর্তমানে যে উচ্চশিক্ষা লাভ করছি সেটিকে অনেকেই উচ্চশিক্ষা বলে স্বীকৃতি দিতেও নারাজ। বর্তমান সময়ের অন্যতম বুদ্ধিজীবী প্রফেসর সলিমুল্লাহ খান তার এক বক্তৃতায় বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক শুদ্ধ বাংলা লিখতে অক্ষম। এটি যদি সত্য হয়ে তবে অবস্থা খুবই শোচনীয় বলেই ধরে নিতে হবে। গত জুলাই ’২৪ এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর উপাচার্যদের পদত্যাগের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তা রীতিমত ভয়ংকর। এ যেনো ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সুরম্য অট্টালিকার করিডোরে কিছু মানবসন্তানের আনাগোনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু শিক্ষাদান এবং শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি সেখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। 

সম্পূর্ণ বিষয়টি অতীব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার খুবই যত্নের সঙ্গে যাচাই-বাছাই করে কিছুসংখ্যক গুণী শিক্ষককে ইতোমধ্যেই কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন এবং এ মাসের মধ্যেই বাকিগুলোর নিয়োগ সম্পন্ন করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। সমগ্রজাতি তাকিয়ে আছে তাদের দিকে এবং আশা করছে তারা নিকট অতীত থেকে শিক্ষা নেবেন এবং নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং আত্মসম্মানের কথা মাথায় রেখে অন্ধকারে নিপতিত উচ্চশিক্ষাকে পুনর্জীবন দানে সচেষ্ট হবেন। আর যদি তা না হয়ে গতানুগতিক দুই দশকের ধারায় বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচালনার চেষ্টা করেন তবে আরো একটি কলংকময় অধ্যায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে এটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

লেখক: যুগ্মপরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়       

 

ভিকারুননিসার সেই ফৌজিয়া এবার ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার দৌড়ে - dainik shiksha ভিকারুননিসার সেই ফৌজিয়া এবার ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার দৌড়ে ১৮ দিনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছি : উপাচার্য - dainik shiksha ১৮ দিনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছি : উপাচার্য উপদেষ্টা আসিফ-নাহিদের ছাত্র সংগঠনের সব কার্যক্রম স্থগিত - dainik shiksha উপদেষ্টা আসিফ-নাহিদের ছাত্র সংগঠনের সব কার্যক্রম স্থগিত যারা আপনাদের সেবা করবে তাদের ভোট দেবেন: সারজিস - dainik shiksha যারা আপনাদের সেবা করবে তাদের ভোট দেবেন: সারজিস এখনো প্রস্তুত হয়নি একাদশের, পাঁচ বইয়ের পাণ্ডুলিপি - dainik shiksha এখনো প্রস্তুত হয়নি একাদশের, পাঁচ বইয়ের পাণ্ডুলিপি মাদরাসায় অনুপস্থিত থেকেও ১১ মাসের বেতন তুলেছেন শিক্ষক - dainik shiksha মাদরাসায় অনুপস্থিত থেকেও ১১ মাসের বেতন তুলেছেন শিক্ষক ৬৬ জন ছাত্রকে পাঁচচুলো করলেন শিক্ষক - dainik shiksha ৬৬ জন ছাত্রকে পাঁচচুলো করলেন শিক্ষক প্রশ্নফাঁসের তদন্ত নিয়ে সিআইডি ও পিএসসি মুখোমুখি - dainik shiksha প্রশ্নফাঁসের তদন্ত নিয়ে সিআইডি ও পিএসসি মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0071239471435547