বহিঃশত্রুর আক্রমণ মোকাবিলায় উপযুক্ত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রামের ইবিআরসিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১০ম টাইগার্স পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস উগ্রবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়েছি। আমরা কারো সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই না। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’- জাতির পিতার এই মূলমন্ত্রকে পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হিসেবে মেনে চলছি। আমরা এই নীতিতে বিশ্বাস করি। কিন্তু যদি কখনো বহিঃশত্রুর আক্রমণ হয়, তা যাতে মোকাবিলা করতে পারি, সেজন্য উপযুক্ত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার বিভিন্ন পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভূমিকার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৯২৪ জন বীর সেনানী শাহাদত বরণ করেন এবং ২৩১ জন সদস্য অনন্য দেশপ্রেম, কর্তব্যবোধ ও বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য খেতাবপ্রাপ্ত হন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বলেন, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে রয়েছে আমার আত্মিক ও পারিবারিক সম্পর্ক। আমার দুই ভাই শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও শহীদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল এই রেজিমেন্টের অফিসার ছিলেন। শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল সিনিয়র টাইগার্স এবং শহিদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল জুনিয়র টাইগার্সে কর্মরত ছিলেন।
তিনি বলেন, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একটি পেশাদার, প্রশিক্ষিত ও শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির শুভ উদ্বোধন করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু কম্বাইন্ড আর্মস স্কুল এবং সেনাবাহিনীর প্রতিটি কোরের জন্য স্বতন্ত্র ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনামলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। তিনি ভারত ও যুগোস্লাভিয়া থেকে নৌবাহিনীর জন্য যুদ্ধ জাহাজ সংগ্রহ করেন। তিনি সে সময়ের অত্যাধুনিক সুপারসনিক মিগ-২১ যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার, পরিবহন বিমান, এয়ার ডিফেন্স রাডার ইত্যাদি বিমান বাহিনীতে যুক্ত করেন।
সরকারপ্রধান বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দেই একটি প্রতিরক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে নানা উদ্যোগ নেয়। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ’ এবং ‘মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’, ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং’ এবং ‘আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করি।
তিনি বলেন, আমরাই সর্বপ্রথম সেনাবাহিনীতে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে মহিলা অফিসার নিয়োগ এবং ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে মহিলা সৈনিক ভর্তির যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিই। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় সরকার গঠনের পর প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন যুগোপযোগী সামরিক বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়ন করছি। আমরা ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে করছি। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘বাংলাদেশ পিস বিল্ডিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে আমরা সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন, রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন এবং বরিশালে ৭ পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছি। বিগত ৪ বছরে বিভিন্ন ফরমেশনের অধীনে তিনটি ব্রিগেড এবং ছোট-বড় ৫৮টি ইউনিট প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সম্প্রতি মাওয়া-জাজিরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শেখ রাসেল সেনানিবাস এবং মিঠামইন, রাজবাড়ী ও ত্রিশালে নতুন সেনানিবাস স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আর্মি এভিয়েশনের ফরোয়ার্ড বেজ এবং লালমনিরহাটে এভিয়েশন স্কুল নির্মাণের কাজও প্রক্রিয়াধীন। আমরা সেনাবাহিনীতে নতুন কম্পোজিট ব্রিগেড ও প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড যুক্ত করেছি। প্রতিটি বাহিনীর জন্য অত্যাধুনিক ও যুগোপযোগী অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে। আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্রবাহিনী সব সময় দেশ ও জনগণের পাশে থেকেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য প্রয়োজনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যগণ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, জাতিসংঘ মিশনসহ বিদেশেও উচ্চমানের পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখছেন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ আবারও সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী পাঠানো দেশ হিসেবে গৌরবের স্থানটি দখল করেছে।
সরকারপ্রধান বলেন, ‘সৌম্য, শক্তি, ক্ষিপ্রতা’- এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবময় এবং ঐতিহ্যপূর্ণ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যবাহী এ রেজিমেন্টের ইতিহাস আমাদের সেনাবাহিনীর চেয়েও পুরোনো, যার সূচনা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে। দেশমাতৃকার অখণ্ডতা রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এ রেজিমেন্টের সদস্যরা দেশের অভ্যন্তরে যেকোনো দুর্যোগময় মুহূর্তে জনগণের সেবায় তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে।
ভাষণের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্যারেড পরিদর্শন ও সশন্ত্র সালাম নেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।