জাতীয় নির্বাচনের সময় সরকারে কে থাকবে? এ বিষয়ে সংবিধানে যেটা বলা আছে, সেটাই সোজা পথ। কিন্তু প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন অর্থাৎ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছিল। তবে সেটাও খুব জনপ্রিয় ব্যাপার ছিল, তা নয়। তাই সংবিধানে যেটা আছে, তা বাদ দিয়ে অন্য পথে হাঁটা আমার পছন্দ নয়।
এখন দেখতে হবে সংবিধানের আলোকে কীভাবে নির্বাচন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সুশীল সমাজ থেকে যাঁরা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, কিন্তু যাঁদের ওপর আমাদের আস্থা-বিশ্বাস আছে এমন ব্যক্তি বাছাই করা যেতে পারে। উদাহরণ হিসেব বলা যায়, গ্রামে-গঞ্জে কিছু লোক থাকে যারা সালিশ করে থাকে, তাদের কথা মানুষ শোনে, মান্য করে। আমাদেরও এমন ব্যক্তিবর্গ খুঁজে বের করতে হবে। আর এটা হবে সংবিধানের ১১৮ ও ১২৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী।
১১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ আর ১২৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলী-সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ, নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সংসদের যথাযথ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয়সহ সংসদের নির্বাচন-সংক্রান্ত বা নির্বাচনের সহিত সম্পর্কিত সকল বিষয়ে বিধান প্রণয়ন করিতে পারিবেন।’
আমার প্রস্তাব হলো, সংবিধানের মধ্য থেকেই নির্বাচনী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। সে জন্য ঐকমত্যের ভিত্তিতে কিছু ব্যক্তি বাছাই করতে হবে, যাঁদের নিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করবেন। নির্বাচন কমিশনের সদস্য সংখ্যা ৯ বা ১১ সদস্যের হতে পারে। নির্বাচন পরিচালনার বিষয়ে বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের মোটামুটি অভিজ্ঞতা হয়েছে, কারণ এরই মধ্যে তাঁর অধীনে কিছু নির্বাচন হয়েছে। তাঁর একটা গ্রহণযোগ্যতাও দেখা গেছে। এখন তাঁর সঙ্গে যদি আরও সদস্য যুক্ত করা হয়, যেটা প্রয়োজনে ১১ জন পর্যন্ত হতে পারে। সদস্য সংখ্যা অবশ্যই বিজোড় হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করতে পারেন; আবার রাষ্ট্রপতিও রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে পারেন। এ জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজন হবে। এখন বলা যেতে পারে, রাষ্ট্রপতি এসব কেন করবেন? এটা মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্রপতি কোনো দলের নন। তাঁকে যাঁরা রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিয়েছেন, তাঁরা দলীয় লোক। কিন্তু এখন রাষ্ট্রপতি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি এ বিষয়গুলো নিরপেক্ষভাবে নির্ভীকভাবে করবেন, এটাই তাঁর দায়িত্ব হওয়া দরকার। এটি হলে সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হবে। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ১২৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ ১১৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করবে। যেখানে নির্বাচন কমিশনের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি থাকবে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা হলে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে না।
বাংলায় একটি কথা আছে– ‘ক্যান্টেমি’ (কুষ্টিয়ার ভাষায় গোঁয়ার্তুমি)। যতই নির্বাচন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা হোক, বিএনপি বলেন, অন্য দল বলেন বা আওয়ামী লীগ বলেন; ক্যান্টেমি হবেই। রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্যই হলো রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া। কিন্তু সেটা অবশ্যই সংবিধানের আলোকে হতে হবে। সংবিধানের কোনো দুর্বলতা নেই। সংবিধানেই সব সমস্যার সমাধান আছে। নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে শক্তিশালী করা হলে সেটা সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে। এখানে ব্যক্তি বাছাই অবশ্যই সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে হতে হবে। রাষ্ট্রপতি উদ্যোগ নিতে পারেন বা রাজনৈতিক দলগুলো থেকেও তাঁর কাছে প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। তাহলে আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বা এ ধরনের বিকল্প খোঁজার প্রয়োজন হবে না।