গত বছরের ৬ নভেম্বর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয় এবং ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরীক্ষা চলে। এতে ১২ লাখ ৩ হাজার ৪০৭ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেন। এবার ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখে ওই পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যায়, সব বোর্ডে পাসের হার ৮৬ শতাংশ। গতবার এই হার ছিলো ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। এবার এক লাখ ৭৬ হাজার পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছেন। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন এক লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ জন।
এবার মাদরাসা বোর্ডে পাসের হার ৯২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, দ্বিতীয় কারিগরি শিক্ষাবোর্ড ৯১ দশমিক ২ শতাংশ। সাধারণ বোর্ডের মধ্যে কুমিল্লায় পাসের হার ৯০ দশমিক ৭২ শতাংশ। এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবারও পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক দিয়ে এগিয়ে আছেন মেয়েরা। এবার ছেলেদের পাসের হার ৮৪ দশমিক ৫৩, আর মেয়েদের ৮৭ দশমিক ৮৪। এবার মোট জিপিএ-৫ পাওয়া ছেলের সংখ্যা ৮০ হাজার ৫৬১ এবং মেয়েদের সংখ্যা ৯৫ হাজার ৭২১ জন। গত বছরের তুলনায় এ বছর জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ১২ হাজার ৮৮৭ জন। বেড়েছে শতভাগ অকৃতকার্য প্রতিষ্ঠান, কমেছে শতভাগ পাস। শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে এক হাজার ৩৩০ প্রতিষ্ঠান থেকে।
অন্যদিকে, পরীক্ষায় ৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কেউই পাস করেননি। করেনার সময় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ইংরেজি বিষয়ে পাসের হার যেখানে ৯৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিলো, করোনার পরের বছরই একই পরীক্ষায় ওই বিষয়ে পাসের হার নেমে এসেছে ৯০ শতাংশের নিচে। এতে সার্বিক ফলাফলে পাসের হারসহ জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা কমেছে। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে শুধু ঢাকা বোর্ডে ইংরেজি বিষয়ে পাসের হার ৯২ দশমিক ৩৩ এবং কুমিল্লা বোর্ডে ৯৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এর বাইরে মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজি বিষয়ে পাসের হার ৯৫ শতাংশের ওপরে।
ওপরে অনেক সংখ্যার খেলা দেখা যাচ্ছে, আসলে এগুলো আমাদের কোনো মেসেজ দেয় কী? যেমন : ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে পাসের হার ছিলো ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ, এবার তা কমে হয়েছে ৮৬ শতাংশ। এর কারণ কী? দেশে কি হঠাৎ কোনো হরতাল বা দুর্যোগ বা দুর্বিপাক ছিলো যে, গতবারের চেয়ে এবার এত কম সংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করেছেন? করোনা মহামারির কারণে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে এইচএসসি পরীক্ষা হয়নি। জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়নে শতভাগ পরীক্ষার্থী পাস করেন। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দেও একই কারণে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে পিছিয়ে ডিসেম্বরে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে গ্রুপভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে ছয়টি পত্রে এইচএসসি পরীক্ষা হয়েছিলো। অর্থাৎ, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি, সব বিষয়ে মূল্যায়ন হয়নি। সব বিষয়ে মূল্যায়ন হলে পাসের হার কমে যেতো।
যেখানে মানের কথাটি আসে যেটি নিয়ে আমরা খুব চিন্তিত নই বলে মনে হচ্ছে, আমরা শতভাগ পাস ছুঁই ছুঁই দেখতে পেলেই কেন যে আনন্দিত হই। প্রতিবছর এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর মানসম্মত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংকটের বিষয়টি আলোচনায় আসে। আমাদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রদান করতে না পারায় মানবসম্পদ সৃষ্টিতে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। তাই যেনতেনভাবে গ্রাজুয়েটের সংখ্যা বাড়িয়ে সংখ্যাস্ফীতি দেখালে মানের জায়গা অধরাই থেকে যাচ্ছে। সেই বিষয়টিও কিন্তু খুব আলোচনায় আসছে না। আলোচনায় আসছে যারা পাস করেছেন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের ভর্তির ব্যবস্থা হবে কিনা। এখন তো উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই, অনেক প্রতিষ্ঠান কাঙ্ক্ষিত সংখ্যায় শিক্ষার্থীই পাচ্ছে না।
আরও দুই তিনটি পরিসংখ্যান যদি বিবেচনায় নিই তাহলে সে দুটির অর্থইবা কি দাঁড়ায়? একটি হচ্ছে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার সর্বোচ্চ (৯২ দশমিক ৫৬ শতাংশ)। তার অর্থ কি এই যে, কারিগরি ও সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের অধীন ছেলেমেয়েদের তুলনায় মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের শিক্ষার্থীরা বেশি মেধাবী, কিংবা তারা আরবিও ভাল জানে, বাংলাও ভাল জানে কিংবা অন্যকিছু? এর কোনো সদুত্তর নেই। একইভাবে পাসের হারে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (৯১ দশমিক ২ শতাংশ)। তারাও কি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের চেয়ে অধিকতর মেধাবী কিংবা তারা কারিগরি শিক্ষায় বেশ পারদর্শী? তাদের দক্ষতায় তারা দেশে কিংবা বিদেশে চমৎকার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নিতে পারে, তারা প্রাকটিক্যালি অনেক ভাল, আসলে বিষযটি তাও নয়। দুএকজন ব্যতিক্রম ছাড়া দক্ষতার বাস্তব প্রয়োগে তারা অনেক পিছিয়ে। তাহলে এই ফল থেকে আমরা কি বুঝতে পারি, আমাদের জন্য এটি কি মেসেজ বহন করে? সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের মধ্যে পাসের হারে কুমিল্লা বোর্ড এগিয়ে আছেন কেনো, কীভাবে, এর কি কোনো সঠিক উত্তর আছে?
এবার বেশি শিক্ষার্থী ফেল করেছেন গ্রামগঞ্জের বেসরকারি কলেজগুলোতে। ৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কেউই পাস করেননি, যে সংখ্যা গতবার ছিলো ৫টি। এটিরইবা কি অর্থ, একটি অর্থ হতে পারে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা অকাতরে নকল করার সুযোগ পেয়েছিলেন ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে, এবার হয়তো কোনো কারণে সেটি করতে পারেনি তাই এত প্রতিষ্ঠান ফেল করেছে। এছাড়া এর খুব একটা ভাল ব্যাখ্যা মেলানো যাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক যা গতবার যেভাবে ছিলো এবারও সেভাবেই আছে। তাহলে হঠাৎ এতো প্রতিষ্ঠানের শূন্য পাস কেনো? শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাজধানী ঢাকার কলেজও আছে। শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪৪টির নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন, আর মাদরাসা বোর্ডের ৪টি, আর দুটি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন।
সাধারণত গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও সাম্প্রতিক সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ভীত থাকেন। এর প্রভাব পড়ে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে। করোনার সময় সংক্ষিপ্ত সিলেবাস এবং কম সংখ্যক বিষয়ে পরীক্ষা হওয়ায় কঠিন এই বিষয়গুলোর পাসের হার ওইভাবে চোখে পড়েনি। কিন্তু করোনাকাল কাটিয়ে ওঠার পরই সেই বিষয়গুলোর চিত্র আবার সামনে চলে এসেছে বলে কেউ কেউ বলেছেন। এটি সত্যি কথা। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে নেয়া হয়েছিলো তিন বিষয়ে পরীক্ষা। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের পরীক্ষায় বিষয় বাড়লেও তা হয়েছে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। অর্থাৎ এটিও প্রকৃত মূল্যায়ন নয়। শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন বোর্ডে ইংরেজি প্রথমপত্রে প্রায় ১০ শতাংশ এবং দ্বিতীয়পত্রে ১৭ শতাংশেরও বেশি পরীক্ষার্থী ফেল করেছেন। বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা তিন বিভাগের পরীক্ষার্থীই ইংরেজিতে খারাপ ফল করায় সামগ্রিক ফলাফলে প্রভাব পড়েছে। এছাড়া অর্থনীতি প্রথমপত্রেও প্রায় ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছেন। ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা গতবার খুব ভালো ছিলেন, এবার যারা এইচএসসি পরীক্ষা দিলেন তারা ইংরেজিতে খারাপ হয়ে গেলেন? আগের বছরের শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে কথা বলতে পারতো, লিখতে পারতো, ইংরেজিতে যেকোনো লেখা বুঝতে পারতেন, এবারকার শিক্ষার্থীরা এসব দিক দিয়ে পিছিয়ে, বিষয়টি কি তাই, তাও তো না। তাহলে তফাৎ কেনো? ইংরেজিতে শিক্ষার্থীদের সার্বিক কি অবস্থা, বোর্ড পরীক্ষায় ইংরেজিতে কি পরীক্ষা নেয়া হয় সবই তো আমাদের জানা। তাহলে এই পার্থক্যের কারণও কি ওই যে, দেখাদেখি করে আগের মতো লিখতে পারেননি।
উচ্চ মাধ্যমিক স্তর অতিক্রম করে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার বৃহত্তর জগতে প্রবেশের সুযোগ পান, যা ভবিষ্যৎ জীবন গঠনে ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে অনেক শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞানের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তাতে বোঝা যায়, বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় নানা ত্রুটি রয়েছে। এই ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তি নিয়ে শিক্ষার্থীর অভিভাবক, স্বজন ও সংশ্লিষ্টরা যতোটা আগ্রহ প্রকাশ করেন, শিক্ষার মান নিয়ে তারা তার সিকিভাগের একভাগও আগ্রহী নন।
সংশ্লিষ্টদের মনোভাবে পরিবর্তন না এলে দেশের শিক্ষার মান কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়বে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুগোপযোগী শিক্ষার বিস্তারে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। একজন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেলে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না তিনি কতোটা সৃজনশীল, কতটা প্রবলেম সলভিং দক্ষতা অর্জন করেছেন, রাস্তার ট্রাফিক আইন মেনে চলেন কি না, তার সহযোগী মনোভাব আছে কি না- সহপাঠীদের সঙ্গে, ছোটদের সঙ্গে, বড়দের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয় তা জানেন কি না, তিনি কতোটা সৎ ও দেশপ্রেমিক। অথচ এগুলো সবই বাস্তব জীবনে খুবই প্রয়োজন, যে জন্য শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। জীবনে এগিয়ে যেতে কাজে লাগে, এগুলো জীবনে সাফল্য অর্জনের হাতিয়ার। সমাজে যতো ছোটো বড়ো উদ্যোক্তা হয়েছেন, প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন, অন্য মানুষের জন্য কাজের ব্যবস্থা করেছেন তাদের অধিকাংশরেই এসব গুণ ছিলো এবং আছে। আর যারা শুধু পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তাদের কিন্তু এসব কাজ করতে দেখা যায় না। বরং তারা ওসব প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য ছোটাছুটি করেন।
দুঃখ প্রকাশ করে অনেকে বলেও থাকেন, শিক্ষিত মানুষের দাম নেই, দাম হয়েছে অশিক্ষিত ছেলেমেযয়ের, যারা ক্লাসের পেছনে থাকতেন। আসলে ঘটনা তো তা নয়। তারাই প্রকৃত শিক্ষিত, তারাই সমাজের প্রকৃত উপকার করছেন। আর যারা শুধু পুঁথিগত বিদ্যা আর নম্বর পাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তারা সমাজের জন্য, মানুষের জন্য খুব একটা কিছু করতে পেরেছে এমন বিরল দৃশ্য উদাহরণ ছাড়া সচরাচর দেখা যায় না।