১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ গ্রেফতার করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি মুক্তি পান পাকিস্তানের কারাগার থেকে। তারপর লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন তিনি। অগণিত জনতা তাকে স্বাগত জানায় জয় বাংলা শ্লোগানে। তিনি দেশের মাটিতে পা রেখেই দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটিকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান নিপীড়নের দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেদ করে বাঙালির জন্য নিয়ে আসেন মুক্তির বারতা। তিনি ছিলেন এমনই একজন নেতা যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের স্ফুলিঙ্গে তিমিরাচ্ছন্ন গগণে উদিত হয়েছিলো স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। যার একটি ভাষণই ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র এবং কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে এক মহাপ্রলয় সৃষ্টি করেছিল, যা এখন রীতিমত বিশ্ব ইতিহাসের অনন্য দলিল। একটি বদ্ধ প্রকষ্ঠে আটকে পড়া জাতিকে উদ্ধারের জন্য এমন ভাষণ বিশ্বে বিরল। কৃমি কীটে খাওয়া দগ্ধ শাসন ব্যবস্থার বেড়াজালে বন্দি হয়ে পড়েছিল বাঙালি জাতি, আর এমনই এক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি কালো অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে আলোর স্ফূরণ ছড়িয়ে ছিলো। বাঙালির হৃদয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে ঝংকার তুলেছিলো। অর্ধশত বছর আগে দেয়া সেই কালজয়ী ভাষণেই মুক্তির আস্বাদন পেয়েছিল বাঙালি জাতি। ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলো এবং এমনই অনুপ্ররণামূলক ভাষণ ছিল সেটি যা মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিল এবং বুকের তাজা রক্ত দিতে বাঙালি নূন্যতম কুণ্ঠাবোধ করেনি। বাংলাদেশ আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে গর্বের সাথে। ৫০ বছর আগে সেই ভাষণটি না দিলে আমরা আজ সুবর্ণ জয়ন্তী করতে পারতাম না। মুজিব শতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তাকে হিমালয়ের সাথে তুলনা করেছিলেন কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একজন মহানায়কই নন, তিনি নিজে একটি প্রতিষ্ঠান এবং একটি ইতিহাস।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া ছোট খোকা ধীরে ধীরে কালের আবর্তে ইতিহাসের মহানায়কে পরিণত হন। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে তাকে মোকাবেলা করতে হয় অত্যাচার, নির্যাতন আর ষড়যন্ত্রের বিষাক্ত ছোবল। প্রকাণ্ড ঝড়ের মাঝে উত্তাল সাগরে টিকে থাকা তরীর মত তার জীবন। পাহাড় সম ঢেউ এসেও তার ইচ্ছা তরীকে ডুবাতে পারেনি। এমনটি শুধু কোন মহাবীরের পক্ষেই সম্ভব। সীমাহীন সাহস, অসীম আত্মবিশ্বাস, উপস্থিত বুদ্ধি, প্রজ্ঞা এবং মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা তাকে নক্ষত্রে পরিণত করেছে।
স্কুল থেকেই তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে অসীম সাহসিকতার জন্য শেরে বাংলা তাকে বুকে টেনে নেন। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মেট্রিক পাস করেন এবং কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ইসলামিয়া কলেজে পড়া অবস্থায় তিনি সক্রিয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ৬ দফা পেশ করেন। এর প্রথম দফাটি ছিল স্বায়ত্বশাসন। এটি ছিল মুক্তির সনদ। এসময় তিনি একাধিকবার গ্রেফতার হন। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয় এবং গ্রেফতার হন। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি গনঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে কারামুক্ত হন। সে বছর তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয়। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরষ্কুশ জয় লাভ করে। ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা শুরু হলে তিনি আন্দোলনের ডাক দেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মার্চে তিনি বাংলার মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে কালজয়ী ভাষণ দেন। ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনার দল। ওই রাতেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এর পর তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং সরকার প্রধান হন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সংবিধান কার্যকর হয়। তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যার কাছে নিজের সুখ ছিল খুব তুচ্ছ। তার মতো দূরদর্শী নেতা বিশ্বে বিরল। তিনি ছিলেন গণতন্তের পূজারী এক নির্ভীক দুর্জয় সাহসী জাতীয়াতাবাদী নেতা। অমানিশার ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত দাসত্বের করাল গ্রাসে নিপতিত একটি জাতির জন্য তিনি এলেন আলোর দিশারী হয়ে। তিনি ছিলেন বিশ্ব আইকন, নেতৃত্বের জাদুকর, ইতিহাসের এক বিরাট মহীরুহ। তিনি ছিলেন সৎ, বলিষ্ঠ, অদম্য, দুর্বার ও বিদ্রোহের অগ্নিশিখা। কিংবদন্তি কালজয়ী এই নেতার কণ্ঠে ছিল ইন্দ্রজাল। যার বজ্রকণ্ঠের ভাষণ ইতিহাসের বড় দলিল হয়ে গেছে। ক্ষণজন্মা এই পুরুষ ছিলেন মুক্তির দিকপাল, এক মহা কাণ্ডারি এবং মানবতাবাদের ক্যানভাসে গণতন্ত্রের দিশারী।
তিনি ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা, এক বিরাট বটবৃক্ষ এবং বাতিঘর, যিনি ছিলেন স্বৈরাচার শাসনের বিরুদ্ধে এক প্রবল ঝড়। সাত কোটি বাঙালির প্রাণের প্রদীপ বিশ্ববরেণ্য এই নেতা ছিলেন দেশ প্রেমের এক মূর্ত প্রতীক। রাজনীতির এই মহাকবি ছিলেন তিমিরাচ্ছন্ন গগনের এক দীপ্ত রবি। শোষণের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক মহা স্ফুলিঙ্গ যিনি মহাপ্রাচীর ভেঙ্গে ছিনিয়ে এনেছেন পতাকা এবং একটি মানচিত্র। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু ছিলেন অকুণ্ঠ, সদাশয় ও দূরদর্শী। জননন্দিত, অবিসংবাদিত, অস্প্রদায়িক, সেক্যুলার, আপোসহীন এই বিশ্বনেতার চলার পথ মোটেও মসৃণ ছিল না।
তার স্বর্ণালী দিনগুলি কেটে গেছে রাজপথ, আন্দোলন-সংগ্রাম আর কারাগারের অন্ধ কুটিরে। স্বপ্নের কারিগর, অনলবর্ষী এই বক্তা তার সহজাত গুণের কারণে ঘুমন্ত বাঙালিকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। বিশ্বের বহু নেতা বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু ফসল ঘরে তুলতে পেরেছেন এমন নজির খুব কম। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন এক ব্যক্তি তিনি যা ভেবেছেন তা শুরু করেছেন, সেটাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এবং সেটার ফসল ঘরে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন। আর তার শ্রেষ্ঠত্ব ঠিক এখানেই। ধারাবাহিক সংগ্রামের বলিষ্ঠ এই বীর হিমালয়ের মত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন যা ভেদ করা কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। যার মহান নেতৃত্বে মাত্র নয় মাসে পরাক্রমশালী একটি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাঙালি স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল।
তিনি এমন এক ক্যারিশমেটিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন যার কথায় ও ভালোবাসার টানে বাঙালিরা জীবন দিতে রাজি ছিল। বাঙালি জাতির মুক্তির দূত, নীতিতে অবিচল, উজ্জীবনী শক্তির ধারক, আপন শক্তি বলে প্রকাণ্ড প্রতিবন্ধককে দুমড়ে মুচড়ে ফেলেছিলেন। টর্নেডোর মতো ক্ষিপ্রগতিতে তিনি হাজার বছরের বদ্ধ খাঁচার দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। পরাধীনতার লৌহ শিকলে আটকে থাকা একটি জাতিকে তিনি মুক্ত করেছিলেন। কোন ভয়, কোন ষড়যন্ত্র, কোন ফাঁদ, কোন হুমকি তার এগিয়ে যাওয়ার পথকে প্রতিহত করতে পারেনি। তার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ঘটেছিলো মুক্তির সমর। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের যে নেতৃত্ব তিনি দিয়েছিলেন তা বিশ্বে বিরল। ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছিলো দেশকে ভালোবেসে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মুক্তিযুদ্ধে। আজ আমাদের স্বাধীনতা ৫০ পেরিয়ে ৫১ এ পদার্পণ করলো। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আজও আমরা পরাধীন থাকতাম। স্বাধীন দেশে বাস করে মুক্ত বায়ুতে শ্বাস নিতে পারছি এই মহান মানুষটির জন্য। স্বাধীনতার স্বাদ যে জাতি এখনো পাইনি তারা বোঝে স্বাধীনতার মূল্য কত।
তিনি তার ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া নিয়ে কোন স্বপ্ন দেখতেন না। তার গগনচুম্বী স্বপ্ন ছিল বদ্ধ প্রকোষ্ঠে আটকে থাকা অসহায় মানুষগুলিকে মুক্ত করে স্বাধীনতার স্বাদ দেয়া। বাঙালি জাতি যে শিকলে বাঁধা পড়েছিল সেটা ভেঙ্গে দেয়াই ছিল তার মহা ব্রত।
তিনি তার মূল স্বপ্নটি পূরণ করতে পেরেছিলেন। মুক্তির পরম স্বাদ তিনি বাঙালিদের দিয়েছিলেন। বিশ্বের একজন ত্যাগী সংগ্রামী নেতা হিসাবে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। অসীম সাহসিকতার জন্য ব্রিটিশ রাজকবি টেড হিউজ বঙ্গবন্ধুকে ‘টাইগার অব বেঙ্গল’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। বাঙালিয়ানার প্রবাদ পুরুষ এই মানুষটির বাঙালির প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা। যুদ্ধ বিধস্ত দেশটিকে তিনি যখন নতুনভাবে সাজানো শুরু করলেন ঠিক তখনই কতিপয় জঘণ্য কুচক্রী কিছু অমানুষ তার বুকে গুলি চালালো নির্মমভাবে। বিশ্বাসঘাতকদের হাতে প্রাণ হারালেন তিনি ও তার পরিবার। সৃষ্টি হলো ইতিহাসের সবচেয়ে জঘণ্য কলঙ্কিত অধ্যায়।
লেখক : মাজহার মান্নান, কবি ও কলামিস্ট