যশোর এম এম কলেজের গণিত বিভাগ থেকে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে একইসঙ্গে স্নাতক পাস করেন দুজন তরিকুল ইসলাম। দুজনেরই বাড়ি সদর উপজেলার মাহিদিয়া গ্রামে। একজনের বাবার নাম রুস্তম আলী, অপরজনের আক্কাস আলী। দুই তরিকুল আবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, হরিহর আত্মা। এই সুসম্পর্কের সুযোগ নেন রুস্তুম আলির ছেলে তরিকুল। বন্ধুর শিক্ষক নিবন্ধন সনদ জালিয়াতি করে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। চাকরি বাগাতে বন্ধুর অনার্স-মাস্টার্স সার্টিফিকেট এবং জাতীয় পরিচয়পত্রও জাল করেন। এসব জাল কাগজপত্র দিয়ে তিনি মাহিদিয়া মহিলা আলিম মাদরাসায় ব্যাক-ডেটে নিয়োগ দেখিয়ে এমপিওভুক্তও হন। এতে বিপাকে পড়েন সনদের আসল দাবিদার তরিকুল। গণিতের প্রভাষক হতে নিবন্ধিত হলেও চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করতে পারেননি তিনি। মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের তদন্তে প্রাথমিকভাবে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গত রোববার দুপুরে রাজধানীর নিউ বেইলি রোডে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর কার্যালয়ের বাইরে দৈনিক আমাদের বার্তার সঙ্গে কথা হয় ভুক্তভোগী তরিকুল ইসলামের। তিনি বলেন, আমার বাবার নাম আক্কাস আলি। আর বন্ধু তরিকুলের বাবার নাম রুস্তুম আলি। আমরা দুজন একইসঙ্গে যশোর এম এম কলেজ থেকে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে গণিতে স্নাতক শেষ করে একইসঙ্গে মাস্টার্স করি। কিন্তু বন্ধুই আমার সর্বনাশ করেছে। সে আমার সব সনদ ব্যবহার করে চাকরি করছে। আমার সনদে সে ইনডেক্সধারী হওয়ায় আমি শিক্ষক নিয়োগের চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করতে পারিনি। এর আগের গণবিজ্ঞপ্তিগুলোতেও আমি আবেদন করেছি, কিন্তু এবার ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগ ব্লক করে রাখায় বিষয়টি আমি বুঝতে পারি।
তিনি আরো জানান, ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ওই মাদরাসায় ব্যাক-ডেটে নিয়োগ নেন বন্ধু তরিকুল। পাতানো নিয়োগের কোরামপূর্ণ করতে তাকে সাজানো প্রার্থী বানানো হয়। তরিকুলের দাবি, সাজানো প্রার্থী বানানোর নামে তার সনদ সংগ্রহ করেন রুস্তুম আলির ছেলে তরিকুল। সেগুলো জালিয়াতি করেই তিনি নিয়োগ নিয়েছেন। তার জন্য শিক্ষক পদে নিয়োগের আবেদন করতে পারিনি। আমি তার বিচার চাই।
তরিকুল জানান, চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করতে না পেরে প্রথমেই সন্দেহ হয় বন্ধুকে। তার নিয়োগের সময় কোরাম পূর্ণ করতে সে আমার সনদ ও অন্যান্য কাগজ নিয়েছিলো। তাই মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখার উপপরিচালক জাকির হোসাইন স্যারের কাছে অভিযোগ করেছিলাম। তিনি বিষয়টি যাচাই করছেন।
মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, আক্কাস আলির ছেলে তরিকুলের করা অভিযোগ আমলে নিয়ে তাদের দুইজনের সঙ্গেই মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন। কিন্তু মাহিদিয়া সম্মিলনি মহিলা আলিম মাদরাসার শিক্ষক ও রুস্তুম আলির ছেলে তরিকুল সনদের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারছেন না। তাই তাদের গত রোববার তলব করা হয়েছিলো।
গত রোববার সকাল দশটায় মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে হাজির হয় দৈনিক আমাদের বার্তার প্রতিবেদক। বেলা ১২টার দিকে আসেন আক্কাস আলির ছেলে তরিকুল ইসলাম। তিনি জানান, টাঙ্গাইলের একটি বেসরকারি স্কুলে (ননএমপিও) তিনি কর্মরত আছেন। সেখান থেকেই এসেছেন অধিদপ্তরে। তবে, রুস্তুম আলির ছেলে তরিকুল ইসলাম অধিদপ্তরে আসেননি। পরে দীর্ঘ সময় অধিদপ্তরের একজন উপপরিচালক ও একজন পরিচালক তরিকুলের বক্তব্য নেন। তার সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, তার ভাইয়ের জাতীয় পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য সনদ যাচাই করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদরাসা অধিদপ্তরের উপপরিচালক জাকির হোসাইন দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আমরা সনদ যাচাই করে দেখেছি, আক্কাস আলির ছেলে তরিকুল ইসলামের সনদ সঠিক আছে। আর অপর যে তরিকুল মাদরাসায় শিক্ষকতা করছেন তার সনদ জাল। তিনি রুস্তুম আলির ছেলে হলেও নিয়োগ সংক্রান্ত কাগজপত্রে তার বাবা নাম আক্কাস আলি দেখা যাচ্ছে। শুধু নিয়োগ নয়, তার অন্যান্য কাগজের বাবার নাম আক্কাস আলি দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা যাচাইয়ে জানতে পেরেছি বন্ধুর সনদ জাল করে শিক্ষকতা করা তরিকুলের এমপিও আপাতত স্থগিত আছে। আমরা তার এমপিও বাতিল ও ইনডেস্ক কর্তন করবো। সে প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।
এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় মাহিদিয়া সম্মিলনি মহিলা আলিম মাদরাসার শিক্ষক তরিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি দৈনিক আমাদের বার্তার কাছে দাবি করেন, তার সনদ ঠিক আছে। তিনি নিয়োগ পাওয়ার পর সব সনদ মাদরাসায় জমা দিয়েছেন। তবে তিনি কোন সনদে এমপিওভুক্ত সে বিষয়ে সুস্পষ্ট করে জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, তার মাদরাসার অধ্যক্ষ এ বিষয়ে বলতে পারবেন। তিনি আরো দাবি করেন, দশম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়ে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যশোর মাহিদিয়া সম্মিলনি আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ ফারুক হোসাইন বলেন, ওই শিক্ষক যে সনদ দিয়েছেন সেই সনদেই তিনি কর্মরত আছেন। তার সনদের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তিনি কেনো বলছেন আমি জানি, তা বলতে পারছি না।