আদালতের এজলাসে কক্ষে কাঠগড়ার স্থলে লোহার খাঁচার কীভাবে এলো, কেনোইবা করা হলো। এই নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। মাথা ব্যথা সংবিধানিক অধিকার। তবে এজলাস কক্ষে লোহার খাঁচার প্রচলন খুব বেশি দিন আগে নয়। নির্বাহী বিভাগে থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার আগেই লোহার খাঁচার প্রচলন শুরু হয়। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে আইনজীবী সনদ প্রাপ্তির পর থেকে নিয়মিত আইনপেশায় জড়িয়ে যাই। ওই সময়টায় কোনো আদালতে লোহার খাঁচা ছিলো না। ছিলো কাঠগড়া। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান সিএমএম আদালত ভবন উদ্বোধন করা হয়। ওই ভবনে কয়েকটি এজলাস কক্ষে প্রথম লোহার খাঁচা দেখতে পাই। এরপরও কৌতূহলবশত আইন, বিচার সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় খোঁজ করি, যদি আশাব্যঞ্জক কোনো কিছু পাই। কিন্তু তা মেলেনি। সম্প্রতি আদালতে লোহার খাঁচার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করার পর হৈচৈ শুরু হয়েছে। হাইকোর্ট জানতে চেয়েছে দেশের কোন কোন আদালতের এজলাস কক্ষে লোহার খাঁচা রয়েছে। সেই বিষয়ে আইনসচিবকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছে হাইকোর্ট।
২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ পরবর্তীতে বিশেষ আদালত কিছু আদালতে লোহার খাঁচার কারার নির্দেশনা পাওয়া যায়। যদিও আইনে আছে, অধস্তন আদালতের অনুশীলন এবং কার্যপ্রণালি-সংক্রান্ত ৮২ বিধির ভাষ্যমতে, প্রতিটি আদালতে অভিযুক্তের জন্য উপযুক্ত খাঁচা থাকবে। খাঁচাটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে কোনো আসামি সহজে পালাতে না পারেন এবং খাঁচা থেকে আসামি যাতে পালাতে না পারেন, সে জন্য সেখানে পর্যাপ্ত পুলিশ পাহারা থাকবে।
যদি আসামির আচার-আচরণ দুর্ধর্ষ ও বিপজ্জনক বলে তাদের অতীত রেকর্ড আছে, ডিজিটাল যুগে তাদেরকে কারাগারে রেখেই ভিডিয়োর মাধ্যমে বিচারকাজে যুক্ত করা হয়। তা নিয়েও বির্তকের অবকাশ রয়েছে। বিচার ব্যবস্থার উন্নতির জন্য শুধু লোহার খাঁচা নয়, সবদিক থেকেই আমাদের সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। যতোক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছেন, ততোক্ষণ পর্যন্ত তাকে লোহার খাঁচায় পুরে রাখা অমানবিক, মানহানিকর।
আমির শায়েখ আবদুর রহমান ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবি গঠন করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নথিপত্রের মতে জেএমবি প্রথম নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড শুরু করে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে। ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার একটি সিনেমা হলে বোমা হামলা করে। পরের বছর ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে পহেলা মে নাটোরের একটি সিনেমা হলে, ডিসেম্বরে ময়মনসিংহে চারটি সিনেমা হলে একযোগে বোমা হামলা করা হয়।
তবে যে প্রেক্ষিতেই কাঠগড়ার পরিবর্তে লোহার খাঁচার করা হলো, তার একটা সূত্র থাকা চাই। তা নেই এটি বড়ই রহস্যজনক। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হয়। সেই সময়ের নির্বাহী আমলেই এর প্রচলন হয়েছিলো? সেই সময়ের আসামির বিরুদ্ধে দেয়া ওয়ারেন্ট এর কপি থানায় ঝুলে আছে। মামলার অস্তিত্ব নেই, মামলার নথির অভাবে পুলিশ প্রতিবেদন দিতে পারছে না।
আমাদের আইন আদালতে ফৌজদারি মামলায় ফরিয়াদি বনাম আসামি শ্রেণিভুক্ত করে রাখার রীতি রয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবে আসামি শ্রেণিভুক্ত ব্যক্তিকে বিচারের আগেই আসামি লেখা হয়ে থাকে। দেশের বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থায় প্রত্যেক আসামিকে কাঠগড়াতে দাড়াতে হয়। সে কারণে লোহার খাঁচা অপসারণের আগে বিদ্যমান আইনে সংশোধন করা অপরিহার্য। তা না হলে মামলা হলেই আসামির কলামের ব্যক্তি আসামি হিসেবেই চিহ্নিত হবেন। সংবিধানে যে নাগরিক অধিকার তা লঙ্ঘন হতেই থাকবে। যদি দেশে বিদ্যমান আইন সংস্কার করা হতো, তবে দুর্নীতি মামলায় নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বলতে হতো না- ‘এই প্রথম লোহার খাঁচায় কাঠগড়াতে দাঁড়াতে হলো। এটা একটা দেখার মতো দৃশ্য। এটা আমার জীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা যে লোহার খাঁচার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি।’ এই লোহার খাচার প্রচলন আজ শুরু হয়নি। সংখ্যার হিসেবে প্রায় দুই যুগ। এতোদিন সমাজের মানুষগুলোর দৃশ্য কারো চোখে পড়েনি, পড়লে কেনো অনুভব করলেন না, তা আমার বোধগম্য নয়। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মন্তব্যে কারণে বহির্বিশ্বে দেশের বিচার ব্যবস্থার ও সরকারের ভাবমূর্তিও নেতিবাচক দিকটিই ফুটে উঠেছে।
কাঠগড়ার বদলে খাঁচার ব্যবস্থার কারণে আইনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। আইনের চোখে ন্যায্যতা ও সমতার নীতি অনুযায়ী আদালত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার আগ পর্যন্ত যেহেতু আসামিকে নির্দোষ গণ্য করতে হয়, সেহেতু তার প্রতি এমন কোনো আচরণ করা যায় না, যা নিবর্তনমূলক ও বিচারের আগেই তার প্রতি দোষীর ন্যায় আচরণ বলে প্রতীয়মান হয়। তা ছাড়া খাঁচায় আটকে রাখা অমানবিক, মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্নকারী ও নিষ্ঠুর আচরণ। এক শ্রেণির প্রচারমুখী গণমাধ্যমে পুলিশ তদন্তের আগেই তদন্তের হিসেব-নিকেশ কষে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। যা মুখরোচক হওয়ায় পাঠক লুফে নিচ্ছেন। ফলে মুল গণমাধ্যমগুলো দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছেন।
লোহার খাচা প্রসঙ্গে কথা বলতেই ফৌজদারি আইনজ্ঞ আইনজীবী এ এফ এম রেজাউল করিম হিরন জানান, লোহার খাঁচার ব্যবহারের শুরু একমাত্র দলিল ঢাকার সিএমএম আদালতের বর্তমান ভবন। এটি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে তৎকালীন স্বারাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে উদ্বোধন করেছিলেন। সেই থেকেই লোহার খাঁচার প্রচলন শুরু হয়েছে।
গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা প্রায়শই শুনতে-দেখতে পাই, ঢাকার আদালতের কাঠগড়া থেকে রায় ঘোষণার পর পরই পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে আসামি পালিয়ে গেছেন। আদালত এলাকা থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। গ্রেফতার জঙ্গি আসামিরা কাগুজে আদালত মানে না বলে এজলাস কক্ষে বিচারকের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছেন। সেইসব দিনের ভয়াবহতা বিচারকরা এখনো ভুলতে পারেননি। এখনো জঙ্গি তৎপরতা থেমে যায়নি।
পুলিশের অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের পুলিশ কমিশনার আনিসুর রহমানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সর্ম্পক। আইন পেশার পাশাপাশি প্রথম আলোতে আদালত বিট নিয়ে কাজ করার সুবাদে অনেক কাজ করেছি। তিনি মন্তব্য করেন, সময়ের প্রয়োজনেই হয়তো করা হয়েছিলো। তবে দিন তারিখ তার জানা নেই। আর বলেন, শুরুর দিকে কয়েকটি এজলাস কক্ষে ছিলো, পরবর্তীতে অন্যান্য এজলাস কক্ষেও একই আদলে গড়া হয়।
১৯৯৮ থেকে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ। এই সময়ে গড়ে ওঠে জঙ্গি সংগঠন। সেই সময় কেমন ছিলো আমার দেশের প্রেক্ষাপট। গণমাধ্যম সুত্রে দেখা যায়, ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন-আরএসও ক্যাম্পে জেএমবি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করে। সিলেটে বৃটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার হোসেনের ওপর বোমা হামলা করে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় আর্জেস গ্রেনেড হামলা হয়। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে জেএমবির জঙ্গিদের বোমা হামলায় নিহত হন দুই সহকারী জজ সোহেল আহম্মেদ ও জগন্নাথ পাঁড়ে। সারা দেশে একযোগে জেএমবি জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫–এর (৫)–এ-তে বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’ স্বাভাবিক কারণেই গ্রেফতার জঙ্গিদের বিচারের বিষয়টি সামনে রেখে এবং নিরাপত্তার চিন্তা করেই হয়তো সেই সময় এজলাস কক্ষে লোহার খাঁচা করা হয়েছিলো। এখনো তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বলার সুযোগ নেই।
যদিও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ। এ সনদের অনুচ্ছেদ ১৪ (২)–এ মতে ‘ফৌজদারি অপরাধের জন্য অভিযুক্ত প্রত্যেককে আইন অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত নিরপরাধ গণ্য করতে হবে বা গণ্য হওয়ার অধিকারী। অধস্তন আদালতের আইনজীবী ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের মতে, আমরা এতোটা সভ্য নই, আইনকে পুরোপুরি মেনে চলতে অভ্যস্ত। আসামিরা একটু সুযোগ পেলেই পালিয়ে যান। এমনো ঘটনা প্রায়শই ঘটছে।
আমাদের সব চেয়ে বড় সমস্যা নিজে সমস্যায় পড়লে মনে হয়, এটা তো ঠিক হয়নি। এর সংস্কার প্রয়োজন। ইউরোপ-আমেরিকায় যা সম্ভব বাংলাদেশে তা সম্ভব নয়। তাই যদি হতো তবে বাংলাদেশের শিক্ষিত বড় কর্তারা সম্পদ পাচার করে ইউরোপ-আমেরিকায় পাচার করতেন না। আমার দেশের শিক্ষিত শ্রেণির আমলা-মন্ত্রী, এমপি, আইনজীবী, বিচারক পুলিশসহ বিভিন্ন পেশার মানুষগুলো পরিবার ও সন্তানের নিরাপদ জীবন গড়তে বিদেশে পাঠাতেন না। আমাদের মুখে স্বদেশ প্রেম যতোটা তার সিকি ভাগও যদি দেশের জন্য থাকতে তবে এ দেশ অনেকদূর এগিয়ে যেতো। রাজপথের আন্দোলন এখন আদালতের বারান্দায় এবং আদালত অঙ্গনে সরব। আদালত অঙ্গনে নানা গোষ্ঠী ও মতবাদের মানুষের আনাগোনা। একজন দুর্ধর্ষ আসামিকে আদালত আনা হলে, তার সাঙ্গপাঙ্গরা নিশ্চিয় প্রাকাশ্য আদালতে আসেন না। আদালতে মুরগি মিলনকে হত্যাকাণ্ডের কথা নিশ্চয় আমরা ভুলে যাইনি। আদালতের কাঠগড়া থেকে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার আসামির পালানোর কথা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তাই আদালতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এও মনে রাখতে হবে, আসামি হলেই যেনো তাকে দাগি আসামির তকমা লাগিয়ে না দিই।
লেখক: আইনজীবী ও সাংবাদিক