ঝিনাইদহ-৪ (কালিগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার পরে কলকাতার সঞ্জীবা গার্ডেন্সের বিইউ ৬৫ নম্বর রুম থেকে সবাই চলে গেলেও শেষ পর্যন্ত ছিলেন ঘাতক মোস্তাফিজ ও ফয়সাল। ফ্ল্যাটে এমপি আনারের চুল ও রক্তের দাগ যেন না থাকে ঘাতকদের সেই নির্দেশনা দেন হত্যার মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহিন। পাউডার দিয়ে সবকিছু সুন্দর করে পরিষ্কার করার কথা বলেন তিনি। তাই এই হত্যাকাণ্ডে অন্য ঘাতকরা দেশে ফিরলেও সবার শেষে ১৮ মে ফেরেন মোস্তাফিজ ও ফয়সাল।
১৬৪ ধারায় দেয়া আসামি মোস্তাফিজ ও ফয়সালের জবানবন্দির কথা গতকাল বৃহস্পতিবার এক ভিডিও বার্তায় এভাবেই তুলে ধরেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, মোস্তাফিজ ও ফয়সালকে নিজের ভাটারা থানাধীন বাসায় রাখেন শাহিন। এমনকি কলকাতায় যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট ও ভিসার ব্যবস্থা করেন। মোস্তাফিজ ও ফয়সালের ভুয়া কাগজ তৈরি করেন শাহিনের পিএস পিন্টু। ফয়সালকে হৃদরোগ ও মোস্তাফিজকে কিডনি রোগী বলে মেডিকেল ভিসা তৈরি করেন। পরে বাংলাদেশ থেকে রেল যোগাযোগে কলকাতায় যাওয়ার উদ্দেশে ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়। কলকাতায় গিয়ে প্রথমে হোটেলে থাকেন ও পরে সঞ্জীবা গার্ডেন্সে যান মোস্তাফিজ ও ফয়সাল। ১৩ মে এমপি আনার যখন গোপাল বাবুর বাসা থেকে বের হন, তখন তাকে লাল গাড়িতে করে ওই সঞ্জীবা গার্ডেন্সে নিয়ে যান ফয়সাল। চাপাতি, বস্তা, দড়ি ও যে চেয়ারের সঙ্গে আনারকে বাঁধা হয়েছিল, সেগুলো সবই শাহিনের নির্দেশে নিয়ে আসেন মোস্তাফিজ ও ফয়সাল।
ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, হত্যাকাণ্ড শেষ হলে এক এক করে সবাই চলে গেলেও ওই বাসায় ছিলেন ফয়সাল ও মোস্তাফিজ। সেই সময় শাহিনের সঙ্গে কথা হয়েছে তাদের। শাহিন তাদের নির্দেশ দেন- ফ্ল্যাটটিতে যেন কোনো চুল এবং রক্তের দাগ না থাকে, সবকিছু গুছিয়ে ঠিকঠাকভাবে রাখতে বলা হয় তাদের। এরপর ১৯ মে মোস্তাফিজ ও ফয়সাল বাংলাদেশে চলে আসেন। দেশে আসার টিকেটও কেটে দেন শাহিন। দেশে এসেও শাহিনের ঢাকার বাসার তিন তলায় ওঠেন মোস্তাফিজ ও ফয়সাল।
তিনি বলেন, আনার হত্যাকাণ্ডের ঘাতক আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া যখন ডিবির হাতে গ্রেফতার হন, তখন শাহিনের দেয়া ৩০ হাজার টাকা নিয়ে মোস্তাফিজ ও ফয়সাল বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করেন। এরপর তারা প্ল্যান করে দুর্গম পাহাড়ে যান। পরিকল্পনা অনুযায়ী, খাগড়াছড়ির দুর্গম পাহাড়ের পাতাল কালীমন্দিরে হিন্দুদের ধুতি পরে মা কালীর পূজা শুরু করেন এবং নাম পরিবর্তন করে ফেলেন। এভাবে পলাতক অবস্থায় ছিলেন তারা।
এদিকে গতকাল ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাহবুবুল হকের আদালত আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল পিছিয়ে আগামী ৮ আগস্ট দিন ধার্য করেছেন। একই আদালতে এ মামলার তিন আসামি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেন। তারা হলেন- ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু, শিমুল ভূঁইয়া ও তানভীর ভূঁইয়া। একই সঙ্গে আসামিরা রিমান্ডে নির্যাতনের কারণে অসুস্থ মর্মে চিকিৎসার আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত আবেদনগুলো নথিভুক্ত করেন ও আসামিদের চিকিৎসার নির্দেশ দেন।
প্রসঙ্গত, গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান এমপি আনার। ১৩ মে বন্ধু গোপালের বাড়ি থেকে বের হন। দিল্লি যাচ্ছেন বলে এসএমএসের মাধ্যমে গোপালকে জানান এবং সেখানে পৌঁছে তাকে ফোন করবেন বলেও উল্লেখ করেন। পরে তার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন জানিয়ে ফোন না দেয়ার জন্য সতর্ক করেছিলেন। ১৭ মে আনারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে ১৮ মে নিখোঁজের জিডি করে পরিবার। তবে ১৩ মে কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেন্সের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন আনার। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত এমপি আনারের লাশ পাওয়া যায়নি।